বুটেক্সে রাজনীতি নিষিদ্ধ: কৌশলগত সিদ্ধান্ত নাকি সংবিধানবিরোধী বিতর্ক?

বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) কর্তৃপক্ষের একটি প্রজ্ঞাপন ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। এতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্রসংগঠন কিংবা রাজনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না।
প্রশাসনের ভাষ্যে, এটি শিক্ষার পরিবেশ রক্ষার প্রয়াস। তবে অনেক শিক্ষার্থী ও পর্যবেক্ষকের মতে, এটি একধরনের সংবিধানবিরোধী ও কৌশলগত নিষেধাজ্ঞা। তাঁদের ভাষ্য, প্রজ্ঞাপনের ভাষাগত অস্পষ্টতার কারণে একদিকে এটি শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে, অন্যদিকে ভবিষ্যতে প্রশাসনের ইচ্ছানুযায়ী নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সংগঠনকে অনুমোদনের পথ তৈরি করে দিতে পারে। অনেকের মতে, এটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে এমনভাবে রচিত হয়েছে যাতে প্রয়োজনে কিছু গোষ্ঠীর জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা যায়।
২০২৪ সালের ৮ আগস্ট প্রকাশিত এই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কোনো ধরনের রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্রসংগঠন বা তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেন না।
২০১০ সালের বুটেক্স আইনে প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও নীতিমালা গ্রহণের কথা থাকলেও, রাজনৈতিক অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। ফলে এমন প্রজ্ঞাপন সংবিধানের ৩৭, ৩৮ ও ৩৯ অনুচ্ছেদের আলোকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে—বিশেষত যখন তা শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার হরণ করে।
শিক্ষার্থীদের মতে, যদি কেবল বলা হতো 'বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ', তাহলে তা যৌক্তিক হতো। কিন্তু ‘সব ধরনের’ বলার মাধ্যমে প্রশাসন শিক্ষার্থীর ক্যাম্পাসের বাইরের জীবনেও হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে কিনা, সেই প্রশ্ন এখন অনেকের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আসিফ বলেন, আমি যদি ক্যাম্পাসের বাইরে গিয়ে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিই, তাহলে কি সেটাও নিষিদ্ধ? তাহলে তো এটি আমার ব্যক্তিগত সাংবিধানিক অধিকারেই হস্তক্ষেপ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য ছিলো ক্যাম্পাস পলিটিক্স বন্ধ করা কিন্তু আদৌ কি প্রশাসন এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তা পারবে? বা পারছে?
বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকের মতে, এই নিষেধাজ্ঞার ভাষা ইচ্ছাকৃতভাবে অস্পষ্ট রাখা হয়েছে। আপাতত সবকিছু নিষিদ্ধ করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা হলেও ভবিষ্যতে পছন্দের কোনো সংগঠনকে অনুমোদনের পথ খোলা রাখতেই এই কৌশল। ফলে এটি ভবিষ্যতে পক্ষপাতমূলক প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, এই প্রজ্ঞাপন সহজেই আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যেতে পারে। কেউ একজন রিট করলেই আদালত একে মৌলিক অধিকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করতে পারে। এমন নজির অতীতেও রয়েছে—বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত হাইকোর্ট স্থগিত করেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, এই সিদ্ধান্তটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত হয়েছে। কেবল বুটেক্স নয়, সিন্ডিকেটে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরাও রয়েছেন। কাজেই এটি এককভাবে নেওয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়।
তিনি আরও জানান, যদি কেউ মনে করেন এই সিদ্ধান্ত অবৈধ, তাহলে তিনি হাইকোর্টে রিট করতে পারেন। সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনজীবীরা এই সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরবেন।
নিষেধাজ্ঞার পরও গোপনে রাজনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রকাশ্যে কেউ স্বীকার না করলেও, আদর্শচর্চা যে থেমে নেই তা জানিয়েছেন একাধিক শিক্ষার্থী।
ছাত্রদলের একজন নেতা বলেন, স্বৈরাচার আমলেও আমরা রাজনীতি করেছি, তখনও কেউ নিষেধ করেনি। এখন প্রশাসন আমাদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিচ্ছে, এটা মানা যায় না।
ছাত্রদলের আরেক কর্মী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী যদি রাজনীতি চায়, তাহলে রাজনীতি অবশ্যই আসবে। তাঁর মতে, চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে পারে না। সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা গেলেও, ভবিষ্যতে নির্বাচিত সরকারের অধীনে তা বাতিল করতে হতে পারে।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস)-এর একজন কর্মী বলেন, সংবিধানে সংগঠনের অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, বুটেক্স যদি ছাত্ররাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে, তাহলে সেটি সংবিধানবিরোধী।
রাজনীতি বিষয়ে নীতিনির্ভর অবস্থান জানিয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের একজন দায়িত্বশীল বলেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তটি সামগ্রিকভাবে যুক্তিসঙ্গত হলেও প্রজ্ঞাপনের ভাষায় এমন কিছু মারপ্যাঁচ রয়েছে, যা ভবিষ্যতে বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে। ইসলামী ছাত্রশিবির সবসময় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বিপক্ষে। তারা চায় না কোনো শিক্ষার্থীকে ধানমন্ডি ৩২ বা টিএসসিতে গিয়ে হাজিরা দিতে হোক, কিংবা জোর করে মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতে বাধ্য করা হোক।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষাঙ্গনে হল দখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি বা ক্যান্টিন দখলের মতো অনৈতিক চর্চা কখনো কাম্য নয়। রাজনীতি থাকতে পারে, তবে তা হতে হবে শিক্ষার্থীবান্ধব, নৈতিকতা-ভিত্তিক এবং নেতৃত্বগঠনে সহায়ক। ইসলামী ছাত্রশিবির বুটেক্সে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার্থীদের নৈতিক উন্নয়ন, শৃঙ্খলা চর্চা ও ক্যারিয়ার গঠনে কাজ করে যাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও তা করবে।
তিনি যোগ করেন, রাজনীতি যদি হয় নীতিনির্ভর ও আদর্শভিত্তিক, তবে সেটিই একজন শিক্ষার্থীর চারিত্রিক বিকাশ ও ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের পথপ্রদর্শক হতে পারে।
প্রকাশ্যে না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ (বাগছাস), নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীর এবং বাম সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন দল গোপনে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে প্রজ্ঞাপন ও নিষেধাজ্ঞা প্রসঙ্গে তাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রজ্ঞাপন কেবল প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়—এটি আইনি ও রাজনৈতিক লড়াইয়ের সূচনা হতে পারে। বিশেষ করে যেখানে শব্দচয়ন নিয়েই প্রশ্ন উঠছে, সেখানে এটি প্রশাসনের বিরুদ্ধে সহজেই আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।
প্রজ্ঞাপনের এই অস্পষ্টতা ইচ্ছাকৃত কি না, নাকি বাস্তব সীমাবদ্ধতা থেকে উদ্ভূত—সে প্রশ্নের উত্তর এখনো মেলেনি। তবে এটুকু নিশ্চিত, এই একটি নির্দেশনাই বুটেক্সে প্রশাসন, শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে এক নতুন বিতর্কের সূত্রপাত করেছে। এই প্রজ্ঞাপন কেবল একটি প্রশাসনিক নির্দেশনা নয়—এটি এক নতুন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক দ্বন্দ্বের উন্মোচন, যার সমাধান হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে আদালতের রায়ে, অথবা শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক প্রতিরোধে।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: