রাবি ছাত্রশিবির কেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিচ্ছে?

রাবি ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার প্রায় ৮ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর সংস্কার প্রস্তাবের ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রশিবির৷ দাবিগুলোর প্রতি প্রশাসনের আন্তরিকতা না থাকার অভিযোগ তুলে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দিয়েছে সংগঠনটি। কিন্তু হুট করেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে কেন এতটা কঠোর অবস্থানে ছাত্রশিবির? এছাড়া রাকসু নির্বাচন নিয়েও ক্যাম্পাসে চলছে আলাপ-আলোচনা। ক্যাম্পাসের এসব নানা বিষয় নিয়ে বাংলাভিশনের মুখোমুখি হয়েছেন রাবি ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি মুজাহিদ ফয়সাল। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ সাকিব।
বাংলাভিশন: বর্তমান প্রশাসন দায়িত্ব নেবার প্রায় ৮ মাস পর বেশ ঘটা করেই আপনারা সংস্কার প্রস্তাব ঘোষণা করলেন। প্রশ্ন উঠেছে, হুট করেই কেন ছাত্রশিবিরের পক্ষ থেকে এমন ঘোষণা আসলো?
মুজাহিদ ফয়সাল: আপনারা জানেন এই প্রশাসন রাজনৈতিকভাবে নিয়োগকৃত নয়। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট নিয়েই এই প্রশাসন দায়িত্ব নেয়। সে জায়গা থেকে তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, তারা শিক্ষার্থীদের মনের কথাগুলো বুঝতে সক্ষম হবে। ইসলামী ছাত্রশিবির এ দাবিগুলো নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে কয়েক দফা আলোচনা করেছে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুধু আশ্বাসই দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ ৮ মাস এভাবে অতিবাহিত হওয়ার পর একটি দায়িত্বশীল সংগঠন হিসেবে আমরা মনে করেছি, আর সময়ক্ষেপন করা উচিত নয় এবং শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক সমস্যাগুলো আমাদের পক্ষ থেকে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাভিশন: অনেকেই আবার বলছেন আপনারা রাকসু নির্বাচনের আগে প্রাসঙ্গিক থাকতেই এমন সংস্কার প্রস্তাব দিচ্ছেন। এ ব্যাপারটা কি সত্য?
মুজাহিদ ফয়সাল: না, বিষয়টি এমন নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আস্থা ছিল। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা ততটাই কমে যাচ্ছে। প্রশাসন অনেক সুন্দর সুন্দর ছাত্রবান্ধব কথা বলে; কিন্তু এসব কথার বাস্তবায়ন আমরা দেখছি না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতেই আমাদের একটু দেরি হয়েছে; কিন্তু প্রশাসনের পক্ষ থেকে যতদিন না পর্যন্ত সংস্কারের রোডম্যাপ আসছে, ততদিন পর্যন্ত ইসলামী ছাত্রশিবির রাজপথে থাকবে ইনশাআল্লাহ।
বাংলাভিশন: একটি সংবাদ সম্মেলনে আপনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যর্থ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এছাড়া, প্রশাসনের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারিও দিচ্ছেন। ছাত্রশিবিরের এত কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কারণ কী?
মুজাহিদ ফয়সাল: দেখুন, আমাদের মনে হয় যে এটি শুধু ছাত্রশিবিরের অবজারভেশনই নয়—বরং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীরাই মনে করে বিগত প্রশাসনের সাথে এই প্রশাসনের খুব একটা তফাৎ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দীর্ঘ ৮ মাসে তারা সংস্কার, পরিবর্তন কিংবা সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কার্যকর ভূমিকা আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয়নি। তার শুধু রুটিন কাজগুলোই করে যাচ্ছে। সে জায়গা থেকে আমরা তাদেরকে সফল বলতে পারছি না। আর আমাদের কঠোর অবস্থানে যাওয়ার কারণ যদি বলেন...দেখুন আমরা দীর্ঘ ৮ মাস অপেক্ষা করেছি, প্রশাসনকে সহযোগিতা করার চেষ্টা করেছি যেন তারা শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো সমাধানে কাজ করে। কিন্তু প্রশাসন অন্যান্য সংগঠনের প্রস্তাবনাগুলোর মতো, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সংস্কার প্রস্তাবগুলোকেও আমলে নেয়নি। সেজন্যই আমাদের এ কঠোর অবস্থান এবং মাঠের আন্দোলনে যাওয়া।
বাংলাভিশন: আপনারা যেসব দাবি দিয়েছেন, সেগুলো বাস্তবায়নে তো সময় দরকার। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনেকে কি সুনির্দিষ্ট কোনো টাইম ফ্রেম দিয়েছেন?
মুজাহিদ ফয়সাল: আমরা ২০টি সেগমেন্টে প্রায় ১২৫টি সংস্কার প্রস্তাবনা দিয়েছি। আমরা বলেছি, এরমধ্যে কিছু সমস্যা আছে যেগুলো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এক থেকে দুইদিন কিংবা এক সপ্তাহের মধ্যেও সমাধান করতে পারে। আবার কিছু কিছু সমস্যা আছে যেগুলোর জন্য সময় বেশি লাগবে—যেমন আবাসন সংকটের যে বিষয়টি; এটি সমাধানের জন্য হয়তো-বা ৫ থেকে ১০ বছরও লাগতে পারে। তবে আমাদের চাওয়াটি ছিল ছাত্রশিবিরের পাশাপাশি অন্যান্য সংগঠনগুলোর যে প্রস্তাবনা ছিল, সবগুলোকে একত্র করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করুক।
বাংলাভিশন: ক্যাম্পাসে একটি কথা চাউর আছে, ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মীরা সক্রিয়ভাবে প্রশাসনের বিভিন্ন প্রোগ্রামে সহযোগিতা করেছে; বিশেষত প্রশাসনের গণ ইফতার কর্মসূচিতে। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে আপনারা প্রকাশ্যে সমালোচনা করছেন। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
মুজাহিদ ফয়সাল: হ্যা, অবশ্যই। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যে সকল উদ্যোগ ছিল, ইসলামী ছাত্রশিবির সেগুলোতে সবসময় সহযোগিতা করে আসছে। সেই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেতিবাচক দিকগুলো নিয়েও আমরা সমালোচনা করে আসছি; এবং যেহেতু শিক্ষার্থীদের এ প্রশাসনের প্রতি অনেক প্রত্যাশা ছিল, কিন্তু তারা সেগুলো পূরণে ব্যর্থ হয়েছে—সেজন্যই মূলত আমরা কঠোরভাবে এখন প্রশাসনের সমালোচনা করছি।
বাংলাভিশন: শাখা ছাত্রদল এবং বাম সংগঠনের অভিযোগ—এই প্রশাসনে আপনাদের মতাদর্শ তথা জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের প্রতিনিধিত্ব বেশি; এবং নানা সময়েই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আপনাদের বাড়তি এডভান্টেজ কিংবা প্রাইওরিটি দিয়েছে। এ অভিযোগটি নিয়ে কী বলবেন?
মুজাহিদ ফয়সাল: এটি আমাদের বন্ধু সংগঠনগুলোর হাস্যকর একটি দাবি। শিক্ষার্থীরাও জানে এবং আপনারাও যদি পরিসংখ্যানটা দেখেন, তাহলে সহজেই বুঝবেন বর্তমান প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে কাদের মতাদর্শের শিক্ষকরা বেশি রয়েছেন। ১৭টি হলের প্রভোস্টও দেখেন? আপনি ভালোভাবেই তখন বুঝতে পারবেন ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধি কত শতাংশ, আর জিয়া পরিষদ, ইউট্যাব অথবা জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের প্রতিনিধি কত শতাংশ। সেই তথ্যচিত্র দেখেলেই বুঝবেন, জিয়া পরিষদ, ইউট্যাব অথবা জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের প্রতিনিধি মিলেই প্রশাসনের ৬৫-৭০ শতাংশ পদগুলোতে আছে। সেখানে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী শিক্ষক সমাজের প্রতিনিধি ৩০ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা না।
বাংলাভিশন: রাকসু নিয়ে অনেক আগে থেকেই তোরজোর শুরু করলেও, এখনও নির্বাচন দিতে পারেনি প্রশাসন। অনেকেই বলছেন, রুয়া নিয়ে আপনারা যতটা সক্রিয় ছিলেন, রাকসু নিয়ে ততটা কঠোর অবস্থানে যাচ্ছেন না। এ প্রসঙ্গে আপনার ব্যাখ্যা কী?
মুজাহিদ ফয়সাল: ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর থেকে ছাত্রশিবির রাকসু নিয়ে সোচ্চার ছিল। রুয়া নিয়ে যেটা হয়েছিল...দেখুন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি শক্তিশালী অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন দরকার ছিল। কিন্তু নির্বাচন বাতিলের সিদ্ধান্তে ছাত্রশিবির অযৌক্তিক হিসেবেই দেখেছিল; সেখানে আমাদের সাবেক শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে প্রতিবাদ জানায়। ছাত্রশিবিরও সাবেক শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে সংহতি জানায়। সেটির উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্যই।
আর রাকসু নিয়ে যদি বলি...আপনারা দেখেছেন দীর্ঘ ৮ মাস রাবি প্রশাসন রাকসু নিয়ে শুধু আশ্বাসই দিয়ে গেছে। নির্বাচন আয়োজন নিয়ে এখনও শঙ্কা রয়ে গেছে। সেই জায়গা থেকে ছাত্রশিবির বাধ্য হয়েই আন্দোলনের দিকে যাচ্ছে।
বাংলাভিশন: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মুজাহিদ ফয়সাল: আপনাকেও ধন্যবাদ।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: