নিশি পোহায় তাঁতের শব্দে
নিশি পোহায় তাঁতের শব্দে। লাইনটি শুনেছিলাম সেলিম আল দীনের নাটক ‘হরগজে’। আজ আমারও নিশি পোহাল তাঁতের থট থট শব্দে। এ এক নতুন ভালোলাগার অনুভূতি।
নিজস্ব কাজে বিচরণ টাঙ্গাইলের সদর উপজেলার মাহমুদ নগরের মাকোর কোল গ্রামে। কাজের সুবাদে রাত পোহাতে হয় সে গ্রামে। যদিও সেদিন ঘুম ভাঙার কথা ছিল পাখির কিচিরমিচিরে। তা-না হয়ে ঘুম ভাঙে তাঁতীদের হাত-পায়ের তাল ছন্দের তাঁত বোনার শব্দে।
টাঙ্গাইলের তাঁতের সুনাম ও সুখ্যাতি বিশ্বজোড়া। তেমনি রয়েছে, কিছু ঐতিহ্যবাহী জায়গা। দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন লোক আসে এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে। পর্যটনের একটি কেন্দ্রস্থল হিসেবেও টাঙ্গাইলের গৌরব রয়েছে। টাঙ্গাইলের এসব দর্শনীয় জায়গা খুবই মনোমুগ্ধকর, যা দেখে চোখ জুড়ায় খুব সহজে।
খাল, বিল, নদী-নালা, চর, বন-জঙ্গলে রয়েছে টাঙ্গাইলের নজরকাড়া দৃশ্য। এসব নয়নাভিরাম দৃশ্যের জন্যই হয়তো টাঙ্গাইলের এই ঐতিহ্য থাকবে যুগে যুগে।
টাঙ্গাইলের হাজারো ঐতিহ্যের মধ্যে অন্যতম ঐতিহ্য হচ্ছে টাঙ্গাইলের তাঁত। তাঁতের শাড়ি, গামছা, গজ কাপড় ইত্যাদি। সেই কাপড় দিয়ে বাহারি যতো নকশা। বাংলাদেশে সেই অতীতকাল থেকেই তাঁতশিল্পের প্রচলন চলে আসছে। তাঁত শিল্প এ দেশের বিশেষ করে টাঙ্গাইলের গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। বাংলাদেশে তাঁত শিল্প অগ্রণী ভূমিকা রেখে যাচ্ছে শাড়ির ক্ষেত্রে। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির কদর উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
জাতীয় অর্থনীতিতে টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাঁতের শাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। ফলে শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত লোকের বেকারত্ব হ্রাস পাচ্ছে। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বেকারত্ব থেকে মুক্ত। আত্ম-কর্মসংস্থানের এক অন্যতম মাধ্যমও টাঙ্গাইলের এই তাঁত শিল্প।
তাঁতের গামছা বুনছিলেন দিদার আলী, নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে প্রবেশ করি তার তাঁত ঘরে। দু’জনের মধ্যে অনেক কথোকথন। গাঁথা পড়ি কথার বুনন মালায়। দিনে দশ থেকে বারোটি করে গামছা তৈরি করে দিদার আলী। এতে গামছা প্রতি পায় ২০ টাকা। আর একটি গামছার পিছনে ব্যয় করে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট সময়। এভাবে রোজ ৮০ থেকে ১০০ টাকার আয়ে চলে তার সংসার। এতে তার সংসার কিভাবে চলে জানতে চাইলে, শিল্পের বুননে হাসি বুনে বলেন, এ গ্রামের মানুষ স্ব-স্ব বংশমর্যাদা রক্ষায় তাঁত শিল্পে জীবিকা নির্বাহ করে। ‘আল্লাহই চালাগো বেডি, আল্লাহই চালায়’।
তার নিজের কোনো তাঁতের কারখানা নেই। একজনের অধীনে কাজ করেন। দিদার আলীর মতো অনেকেই কাজ করেন এসব তাঁত ঘরে। তাঁতের কারখানা দিতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তার যোগান দেয়া সম্ভব নয় এই কর্মীদের। তবে সংশ্লিষ্টরা যদি আর একটু নজর দিতো তাহলে কারখানার আয়তন, পরিবেশ ও তাদের পারিশ্রমিক আর একটু বাড়ত বলেই জানান এই শিল্পের কর্মীরা।
উল্লেখ্য, সারা বিশ্ব যেখানে জানে টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের ঐতিহ্য। সেখানে হঠাৎ ২ ফেব্রুয়ারি এ শাড়িকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্য দাবি করে জিআই স্বীকৃতি দেয়া হয়।
টাঙ্গাইল শাড়ির এমন অস্তিত্ব সংকটে জিআই ফিরিয়ে আনার দাবি তুলেন এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রায় সাড়ে তিন লাখ মালিক-শ্রমিক।
মঙ্গলবার টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক মো. কায়ছারুল ইসলাম ই-মেইলের মাধ্যমে আবেদন ও প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ পাঠান। বুধবার মন্ত্রণালয়ে হার্ড কপি জমা দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর এ স্বীকৃতি দেয়।
এর আগে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই স্বীকৃতি পেতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, শিল্পনকশা ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরে আবেদন করা হয়।
বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই স্বীকৃতি দিয়ে এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয় বলে জানান, শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা।
বিভি/এইচএস
মন্তব্য করুন: