• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

নিয়মিত হাত ধুতে বলায় পিটিয়ে মারা হয়েছিলো যে চিকিৎসককে!

আহমেদ জহুর, কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক 

প্রকাশিত: ২১:১৮, ১৫ অক্টোবর ২০২২

ফন্ট সাইজ
নিয়মিত হাত ধুতে বলায় পিটিয়ে মারা হয়েছিলো যে চিকিৎসককে!

ছবি: ইগনাজ স্যামেলওয়াইজ

নিয়মিত হাত ধোয়ার কথা বলার অপরাধে ১৫৬ বছর আগে পিটিয়ে মারা হয়েছিল হাঙ্গেরির বিশিষ্ট  চিকিৎসক ইগনাজ স্যামেলওয়াইজকে। শনিবার (১৫ অক্টোবর) বিশ্ব হাত ধোয়া দিবসে তাঁকে হৃদয়ের  শ্রদ্ধাঞ্জলি।

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি ভিয়েনা জেনারেল হাসপাতালে প্রসূতি মৃত্যুর হার ছিল আশঙ্কাজনক। সাধারণের চেয়ে তিনগুণ বেশি প্রসূতি মারা যেতেন। চাইল্ড বেড ফিভার নামের এক ধরনের সমস্যায় ভরা ছিল। স্যামেলওয়াইজ লক্ষ করেছিলেন এর মূল কারণ অপরিচ্ছন্নতা। প্রসূতি বিভাগের চিকিৎসকদের তিনি নির্দেশ দিলেন, গর্ভবতী মহিলাদের পরীক্ষা করার আগে হাত ভাল করে ক্লোরিনেটেড লাইম দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। যে সব যন্ত্রপাতি দিয়ে পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেগুলোও ধুয়ে নিতে হবে। তখন ভেতরে ভেতরে ক্ষুব্ধ হলেও তা মানতে বাধ্য হয়েছিলেন চিকিৎসকরা। পরে দেখা গেল, শুধু এটুকুতেই মৃত্যুর হার প্রায় ৯৯ শতাংশ কমে গিয়েছে। পুরো বছরে একজনও হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করল না।

স্যামেলওয়াইজ খুশি হয়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে লিখতে শুরু করলেন। তবে জীবাণু সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা ছিল না তাঁর। তিনি নানা পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করছিলেন। অবশ্য দেখা গেল, এরপরও ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা বেঁকে বসলেন। তবে কি রোগী মারা যাওয়ার জন্য ডাক্তারদের দোষারোপ করছেন ইগনাজ স্যামেল ওয়াইজ? এবার বেঁকে বসলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও।

কিছুটা মন খারাপ করে হাঙ্গেরিতে নিজের ঘরে ফিরে এলেন স্যামেল ওয়াইজ। অনেক ভেবে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করলেন। এরপর ১৮৬১ সালে এক বিজ্ঞান পত্রিকায় গবেষণামূলক প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি জানালেন, টয়লেট ব্যবহার করে, ছোটখাটো অপারেশন বা রোগীকে পরীক্ষা করার পর চিকিৎসকদের ভালো করে হাত ধুয়ে নেওয়া উচিত। কারণ তিনি বারবার দেখেছেন, মর্গ থেকে এসে ডাক্তাররা যখন রোগী দেখেন তখন মৃতদেহ থেকে ভয়ঙ্কর কিছু জীবাণু রোগীর শরীরে চলে আসে। তাতেই অনেকে মারা যান।

কিন্তু তাঁর গবেষণালব্ধ তথ্য কেউ বিশ্বাস করলো না। কারণ তখন ডাক্তার কিংবা বিজ্ঞানী সবার বিশ্বাস ছিল রোগ-শোক-মৃত্যুর কারণ হচ্ছে দুষ্ট আত্মা। মানুষের সাধ্য নেই তাকে অতিক্রম করে। অন্যান্যদের সঙ্গে সঙ্গে স্যামেল-ওয়াইজের স্ত্রীও কূ-সংস্কারে সাঁই দিলেন, ভাবতে শুরুর করলেন যে তিনি পাগলের মতো কথাবার্তা বলছেন। তবে
ইগনাজ স্যামেল ছিলেন নাছোড়। তিনি এবার স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের চিঠি পাঠিয়ে অনুরোধ করলেন, যাতে হাত ও যন্ত্রপাতি ধুয়ে তবে রোগী পরীক্ষা করেন বা অপারেশন করেন। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর বড় রাস্তা এটি। আর সব জেনেও যদি তারা পরিচ্ছন্নতার কাজটুকু না করেন তাহলে ধরে নিতে হবে তারা নিজের অজান্তে মানুষ খুন করার মতো অপরাধ করছেন।

এবার পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করলো। সবাই মিলে তাকে পাগল বলতে থাকলো। ১৮৬৫ সালে নার্ভাস ব্রেকডাউন হওয়ার পর তাঁকে পাঠানো হল মানসিক হাসপাতালে। কেউ কেউ বললেন ‘নিউরো সিফিলিস’ হয়েছে, আবার কেউ বললেন আত্মা ভর করেছে। হাসপাতালে চিকিৎসার পরিবর্তে শুরু হল মারধর। ১৪ দিনের মাথায় মারের চোটে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেলেন তিনি। কোনও চিকিৎসার সুযোগ পেলেন না, সেভাবেই পড়ে রইলেন! পচন ধরল ডান হাতে, সেখান থেকে বিষ ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরে।

১৮৬৫ সালের ১৩ আগস্ট বিনা চিকিৎসায় মাত্র ৪৭ বছর বয়সে সেপ্টিসেমিয়া হয়ে মারা গেলেন তিনি। তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত হলেন না একজন চিকিৎসকও। তাঁকে নিয়ে এক কলমও লেখা হল না হাঙ্গেরিয়ান মেডিক্যাল সোসাইটিতে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাননি তিনি। দেরিতে হলেও তার মূল্যায়ন হয়েছে লুই পাস্তুরের হাত ধরে। স্বীকৃতি পেয়েছে তার গবেষণা। জীবাণু তত্ত্ব, অর্থাৎ জীবাণু থেকে রোগ হতে পারে তা মেনে নিতে বাধ্য হলেন বিজ্ঞানীরা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে গেল তাঁর নাম। হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট আজও তার স্বাক্ষর বহন করছে। সূত্র: বিবিসি, আনন্দবাজার, উইকিপিডিয়া 

 

বিভি/এমআর

মন্তব্য করুন: