• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫

Drama: Jamai Bou Chor
Drama: Jamai Bou Chor

জলবায়ু পরিবর্তনে বিপর্যস্ত সাতক্ষীরার স্বাস্থ্য 

বাল্যকালে সন্তানধারণ: অপুষ্টিতে ভুগছে সাতক্ষীরার অধিকাংশ মা ও শিশু (ভিডিও)

প্রকাশিত: ১১:৫০, ১৬ নভেম্বর ২০২২

আপডেট: ২০:০৪, ২১ মে ২০২৩

ফন্ট সাইজ

পুষ্টিহীনতায় ভোগা ১৩ মাসের শিশুকে নিয়ে সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়েছেন মা সালমা বেগম। চিকিৎসক জানিয়েছেন, মায়ের পুষ্টিহীনতার কারণে এই শিশু মায়ের পেট থেকেই ভুগছিলো পুষ্টিহীনতায়। যার কারণে জন্ম থেকেই নানান রোগে ভুগছিল সে।

সালমা বাংলাভিশনকে বলেন, আমার বাচ্চার সবসময় জ্বর, কাশি লেগেই থাকে। এখন সে দাঁড়ালেই পড়ে যায় এজন্য হাসপাতালে এনেছি। বাচ্চাতো অসুস্থ তাকে কি দেখবো আমি নিজেই দাঁড়াতে পারি না। মাথা ঘুরে পড়ে যাবো পড়ে যাবো মনে হয়। ডাক্তার বলেছেন আমারও পুষ্টিহীনতা রয়েছে। রক্ত দিতে হবে, স্যালাইন দিতে হবে।

দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য বলছে, প্রতি মাসে হাসপাতালটির স্যাম কর্নারে ভর্তি হয় অন্তত ৩ থেকে ৪ জন পুষ্টিহীন শিশু। আর কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে কম পুষ্টিতে ভোগা শিশুর সংখ্যা ৪০ শতাংশেরও বেশি। দারিদ্রতা ও মায়ের অসচেতনতার পাশাপাশি বাল্যবিয়েই এর প্রধান কারণ বলছেন পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা।

পুষ্টিবিদের এই বক্তব্যের সত্যতাও মিলে সাতক্ষীরার বিভিন্ন পাড়া ঘুরে। সরেজমিনে দেখা যায়, এখানকার প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়া মায়েদের বেশিরভাগই ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সী। দেবহাটা উপজেলার পারুলিয়া ইউনিয়নে জেলিয়াপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিকের রোগীর তথ্য যাচাই করে দেখা যায় এখানে প্রতি মাসে ১ হাজার থেকে ১২শ’রোগী চিকিৎসা নেন। যার ৬০ শতাংশই মা। এসব মায়েদের ৫০ শতাংশই ১৮ বছরের কম বয়সী।

জেলার বিভিন্ন তথ্য ও পরিসংখ্যান যাচাই করে দেখা যায়, ২০২১ সালে জাতিসংঘ জরুরি শিশু তহবিল-ইউনিসেফের এক জরিপে উঠে এসেছে এই জেলায় মোট বিয়ের ৭৭.৭ শতাংশই হচ্ছে বাল্যবিয়ে। আর জেলা শিক্ষা অফিস বলছে, শুধু করোনাকালেই এখানে বাল্যবিয়ে হয়েছে ৫৪০ জন স্কুল শিক্ষার্থীর। এই সময়ে শিক্ষাজীবন শেষ করেছে জেলার ১২ শতাংশ স্কুলগামী কিশোরি। অপরিণত বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসা এসব নারী ও তাদের সন্তানরা নানান স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে বলে জানাচ্ছেন ভুক্তোভোগী নারীরাই।

গিতা রানি নামে এক মা জানান, ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগে জন্ম দেওয়া তার ছেলে প্রতিবন্ধী হয়েছে। তিনি বলেন, আমার শিশুটি জন্ম থেকেই খুব দুর্বল ছিল। তার নিউমোনিয়া হয়েছিল। সে দুধ টেনে খেতে পারতো না। সবশেষ একদিন সকালে গোসল করতে গিয়ে দেখি সে নিস্তেজ হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি সাতক্ষীরা মেডিকেলে নিলে ডাক্তার বলেছেন পুষ্টিহীনতার কারণে এটা হয়েছে। সেই থেকে সে প্রতিবন্ধী।

কুলসুম আক্তার বলেন, আমার বিয়ে হয়েছে ১৩ বছর বয়সে। এখন আমার তিনটা সন্তান। এদের পালতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। আমার বড় সন্তানটি মেয়ে। আমার বাবা যদিও আমাকে ১৩ বছর বয়সে বিয়ে দিয়েছেন কিন্তু এখন তিনি আমাকে সাবধান করেছেন আমি যেন কোনোভাবেই আমার মেয়েকে ১৮ বছরের আগে বিয়ে না দেই।

দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সালমার সঙ্গে ছিলেন তার মাও। তিনি বলেন, আমি ভালো সমন্ধে দেখে ক্লাস নাইনে থাকতে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এখন বুঝতে পারছি অনেক ভুল করেছি। আমার মেয়েটাকে কম বয়সে বিয়ে দেওয়ায় মেয়ে এবং নাতনির এখন এই অবস্থা। আর কেউ যেন অল্প বয়সে বিয়ে না দেয় সেটা আমার অনুরোধ।

কিন্তু কেন এত বাল্যবিয়ে? জানতে গিয়ে, চরম দারিদ্রতা, সামাজিক অবক্ষয় ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নারীদের স্বাস্থ্যগত নানার ঝুঁকির কথাই উঠে এসেছে স্থানীয়দের বক্তব্যে। 

দেবহাটা ইউনিয়ন পরিষদ ৪ নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার বলেন, দুর্যোগের কারণে আমাদের এলাকার মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। ঋণের ওপর ঋণ চলছে। এ অবস্থায় মেয়ে ঘরে বসিয়ে রাখা সবাই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে। তাছাড়া এলাকায় অনেক অবক্ষয়। তরুণরা মাদকসেবী হয়ে যাচ্ছে। একারণে মেয়েরা আরও ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। তাই মেম্বার-চেয়ারম্যানকে না জানিয়ে লুকিয়েই বিয়ে দেয়। বেশিরভাগ বিয়ে কোর্টে গিয়ে করে।

৫ নং দেবহাটা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন বলেন, সামাজিক নানান কুসংস্কার প্রচলন আছে, মেয়েদের শারীরিক সমস্যার ঝুঁকি আছে। সবাই চিন্তা করে মেয়েকে ঘরে বসিয়ে রাখলে যে কোনো সময় কিছু ঘটে গেলে আর বিয়ে দিতে পারবে না। তাই চুরি করে বিয়ে দেয়। আমরা বাধা দিলে বলে আপনারা আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিচ্ছেন। বেশিরভাগ গরিব পরিবারগুলো এটা করে।

বাল্যবিয়ে কিভাবে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে জানতে চাইলে পুষ্টিবিদ ডা. রুমানা আক্তার বাংলাভিশনকে বলেন, জন্ম থেকে ১ হাজার দিন একটা শিশুর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় তার শারিরীক গ্রোথ, ব্রেন ডেভেলপমেন্টসহ শারীরিক অনেক বৃদ্ধির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। গবেষণায় দেখা গেছে, এই সময়ে যথাযথ পুষ্টি পাওয়া শিশুরা অন্য বাচ্চাদের থেকে মেধা, শক্তি, সুস্থতা সবদিক থেকে এগিয়ে থাকে।

তিনি আরও বলেন, বাচ্চা পেটে আসার পর মা এবং সন্তান দু’জনেরই বাড়তি পুষ্টির প্রয়োজন হয়। কিন্তু মা যদি পুষ্টিহীন হয় তাহলে সেই মা সন্তানের পুষ্টির জোগান দিতে পারে না। ফলে শিশুর পেট থেকেই পুষ্টিহীন হয়ে বেড়ে উঠে। 

মা কম বয়সী হলে সন্তানের ওপর কিভাবে প্রভাব পড়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সাধারণত একটি মেয়ের শারীরিক বৃদ্ধি ১৮ বছর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। এ সময়ে তার নিজেরই অনেক চাহিদা থাকে। এর মধ্যে কোনো মেয়ের পেটে সন্তান এলে শিশুর জন্য যথাযথ পুষ্টি তার শরীর থেকে সরবরাহ হয় না, ফলে মা শিশু উভয়ে পুষ্টিহীন হয়। এছাড়া, রক্তের স্বল্পতাজনিত কারণে সে রক্তচাপ, এনিমিয়া, অসময়ে বাচ্চা প্রসবসহ বিভিন্ন জটিল সমস্যায় পড়ে। এই অবস্থায় নিজের দুর্বলতার কারণে শিশুর যথাযথ যত্ন নিতে পারে না। এতে শিশু আরও দুর্বল হয়ে পড়ে।

জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন প্রভাবে পুষ্টিহীনতা তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়ে দেবহাটা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুল লতিফ বলেন, আমাদের এই অঞ্চল ব্যাপক দুর্যোগপ্রবণ। বছরে দু’একটা ঝড় এখানে আঘাত করেই। তখন নানান সংকটে শিশুর যত্ন নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে শিশুরা পুষ্টিহীন হয়ে পড়ে।

তিনি আরও বলেন, সাধারণত ঝড় হলে ফসলের ক্ষতি হয়। দুধ-ডিমসহ পুষ্টিকর ফলের সংকট তৈরি হয়। তাছাড়া, উপকূলের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বলে পুষ্টিকর খাবার কিনেও খাওয়াতে পারে না। এতে পুষ্টিসংকটে পড়ে মা ও শিশু।

পিছিয়ে পড়া জনপদে শিশুদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার নিয়ে কাজ করছে আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনসহ স্থানীয় বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগি সংগঠনের একটি কনসোর্শিয়াম। তাদের পরিচালিত রাইট টু গ্রো প্রজেক্ট-এর ম্যানেজার মো. তাওফীকুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন যে এখানকার অর্থনীতি, খাদ্য উৎপাদন, স্যানিটেশন, স্বাস্থ্য ও পুষ্টিব্যবস্থায় সংকট তৈরি করছে এটা সুস্পষ্ট। এতে এই অঞ্চলের মানুষ মসতলের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। ফলে ব্যহত হয় তাদের পুষ্টিব্যবস্থাও। পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীকে মূল ধারার সাথে একত্রিত করতে হলে এখানকার জলবায়ুর ক্ষতি পুশাতে বাড়তি বরাদ্দ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, বিশেষ করে স্বাস্থ্যের বরাদ্দের পাশাপাশি পুষ্টির বরাদ্দ যুক্ত করা দরকার। আমরা এ বিষয়টি সরকারের সঙ্গে এডভোকেসি করছি। আমরা সরকারকে পরামর্শ দেব, শিশুদের পুষ্টি নিশ্চতে ইউনিয়নে আলাদা বরাদ্দ দিতে। কারণ নয়লে পুষ্টিহীন এই শিশুরাই আগামীতে রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। 

বিভি/রিসি

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2