বদর যুদ্ধ: ইসলামের ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক বিজয়

ছবি: বদর প্রান্তর, সৌদি আরব (সংগৃহীত)
সৌদি আরবের মদিনা শহর থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বদর হুনাইন প্রান্তর, যেখানে প্রায় ১৪০০ বছর আগে একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো। এটি ছিলো এমন একটি যুদ্ধ, যা বিশ্বের অন্যতম ‘ইতিহাস-নির্ণায়ক’ যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হয়। সামরিক দিক থেকে যুদ্ধে মুসলিমদের সৈন্যের সংখ্যাও ছিলো খুবই কম, তবে এই যুদ্ধের মাহাত্ম্য এতোটাই ছিল যে, পবিত্র কোরআন শরিফে এই যুদ্ধের উল্লেখ রয়েছে।
মদিনার নব্য মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য বদরের যুদ্ধ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ, যা রাজনৈতিক, সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল। বদরের যুদ্ধের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে প্রথমেই জেনে নিতে হবে কেন এটি মুসলিমদের একটি ঐতিহাসিক বিজয় হিসেবে চিহ্নিত হয়।
১৭ রমজান ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত মহত্বপূর্ণ একটি দিন। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজানের এই দিনে মদিনার মুসলিম ও মক্কার অমুসলিমদের ভেতর বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধের আগে কিছু ছোটখাটো লড়াইয়ের ঘটনা ঘটে থাকলেও, বদরের যুদ্ধই ছিল উভয় দলের ভেতরকার প্রথম বড় যুদ্ধ।
বদর নামের পেছনে একটি জনপ্রিয় ঘটনা রয়েছে। বদর বিন ইয়াখলাদ নামের এক ব্যক্তি সেখানে একটি কূপ খনন করেছিলেন। কূপটির পানি ছিলো অত্যন্ত স্বচ্ছ। সেই পানিতে দেখা যেতো চাঁদের প্রতিফলন। আরবি ভাষায় চাঁদকে বলা হয় বদর। ফলে, এই স্থানটির নাম রাখা হয় বদর। প্রাক-ইসলামি যুগে প্রতি বছর সেখানে বড় একটি উৎসবও উদযাপন করা হতো।
ডিম্বাকৃতির একটি বিশাল এলাকাজুড়ে বদর প্রান্তর। বদর প্রান্তরের প্রস্থ প্রায় সাড়ে ৪ মাইল। এটি ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত উল্লেখযোগ্য একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। মক্কা ও মদিনা থেকে আসা দুটো পথ একত্রিত হতো এখানে। ফলে, স্থানটি বাণিজ্যিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। লোহিত সাগরের কাছাকাছি হওয়ায় এই স্থানটির কৌশলগত মুল্যও ছিল ব্যাপক।
মদিনায় হিজরত করার আগে মক্কার প্রধান নেতারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে ছিল। এদিকে, বদর যুদ্ধের পেছনে জড়িয়ে ছিল একাধিক কারণ। তৎকালীন রজব মাসে মক্কার এক গোত্রপ্রধান আমর বিন আল-হাদরামি দুর্ঘটনাবশত মুসলিমদের হাতে নিহত হন। সেসময়, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রস্তাব দিলেও, মক্কার কুরাইশ নেতারা এতে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুনের মতে, বদর যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল এই ঘটনা।
শাবান মাসে ঘটে আরেকটি ঘটনা। সেসময়, সিরিয়া থেকে মক্কায় আসা কুরাইশদের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা সম্পর্কে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। বলা হয়, মুসলিমরা হয়তো সেটিকে আক্রমণ করতে পারে। কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান মক্কায় সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠান। এরপর মক্কা থেকে কুরাইশদের একটি বড় বাহিনী মদিনার দিকে রওনা হয়। যদিও কাফেলাটি নিরাপদে মক্কায় ফিরে যায়, তবুও আবু জাহলের প্ররোচনায় কুরাইশ বাহিনী মদিনার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ১৬ রমজান তারা বদর প্রান্তরে শিবির স্থাপন করে। এসময়, তাদের সেনা সংখ্যা ছিল প্রায় ৯০০ থেকে ১,০০০ জন।
৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ রমজান মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাল্লাম ৩১৩ জন সাহাবীসহ বদর প্রান্তরে উপস্থিত হন। যুদ্ধের আগে কুরাইশদের কিছু ব্যক্তি যুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন, তবে আবু জাহেলের একগুঁয়েমির কারণে তা হয়নি।
একক সংঘর্ষের শুরুতে কুরাইশদের ৩ সদস্য নিহত হন। এরপরই শুরু হয় মল্লযুদ্ধ। মক্কার নেতা আবু জাহেলকে হত্যা করেন মুসলিম বাহিনীর দুই তরুণ যোদ্ধা মুয়াওজ ও মুয়াজ। যদিও মুসলিম বাহিনী সংখ্যায় কম ছিল, তবুও তারা কৌশলগতভাবে কুরাইশ বাহিনীর উপর এক মারাত্মক আক্রমণ চালিয়ে যুদ্ধের পটপরিবর্তন ঘটায়। যুদ্ধে মক্কার কুরাইশদের ৭০ জন নিহত হয় ও ৭০ জন বন্দী হয়ে পড়ে। বন্দীদের মুক্তির বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ৪ হাজার ৪শ’ দিরহাম বা ১০ জন আনসার শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়।
বদর যুদ্ধের প্রভাব শুধু সামরিক বিজয়ের ভেতরই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং এর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাবও ছিল অত্যন্ত গভীর। মক্কার কুরাইশরা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিজেদের আত্মবিশ্বাস ও সম্মান হারিয়ে ফেলে। যুদ্ধের পর বদরের বাণিজ্য পথ ব্যবহারের ঝুঁকি বেড়ে যায়, যা মক্কার অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। কুরাইশদের বাণিজ্যিক পথ অনিরাপদ হয়ে উঠলে, তাদের মর্যাদাও অন্যান্য গোত্রের কাছে হ্রাস পায়।
এই যুদ্ধে মুসলিম সম্প্রদায়ের আত্মবিশ্বাস ও ঐক্য আরও দৃঢ় হয়। এটি মদিনার মুসলিম রাষ্ট্রের ভিত্তি মজবুত করার সাথে সাথে ইসলামের বিস্তারে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। অতএব, বদর যুদ্ধ শুধুমাত্র একটি সামরিক লড়াই ছিল না, বরং এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক যুদ্ধ, যা বিশ্ব ইতিহাসে ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্থান করে নেয়।
বিভি/আইজে
মন্তব্য করুন: