• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ০৪ মে ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

নির্বাচনের সময় কিশোর গ্যাং বাড়ার আশঙ্কা

প্রকাশিত: ১৫:৫০, ১৫ অক্টোবর ২০২৩

ফন্ট সাইজ
নির্বাচনের সময় কিশোর গ্যাং বাড়ার আশঙ্কা

নির্বাচনকে সামনে রেখে কিশোর গ্যাং-এর তৎপরতা আরো বাড়তে পারে৷ গড়ে উঠতে পারে আরো নতুন নতুন গ্রুপ। বিশ্লেষকরা বলছেন, স্থানীয় পর্যায়ের অপরাধী চক্র ও রাজনৈতিক নেতারা এইসব কিশোর গ্যাং-এর নেপথ্যে আছে৷ আর নির্বাচনের কাজে লাগাতে তারা নতুন নতুন গ্যাং তৈরিতে ইন্ধন দিচ্ছে।

গত ২৪ আগস্ট ঢাকার দক্ষিণখান এলাকায় কিশোর গ্যাং-এর সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে রাফসান নামে ১৭ বছরের এর কিশোরকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে আরেক কিশোরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে সিগারেট খাওয়া নিয়ে দ্বন্দ্বে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।

এর আগে গত ১৭ মে ঢাকার মিরপুরে এক স্কুল ছাত্রকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা। কিশোর গ্যাং-এ যুক্ত হতে না চাওয়ায় সিয়াম (১৪) নামের ওই কিশোরকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে। নিহত কিশোরের পরিবারের অভিযোগ, ওই কিশোর গ্যাং-এর পিছনে প্রভাবশালীরা জড়িত। পুলিশ আট জনের বিরুদ্ধে মামলা নিলেও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা নেয়নি।

গত জুন মাসে ফেনীতে এক স্কুল ছাত্রকে মারধর করে কিশোর গ্যাং-এর তিন সদস্য গ্রেপ্তার হয়। তারা ওই স্কুল ছাত্রকে মারধরের পর তার ভিডিও ধারণ করে আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছিলো।

একই মাসে ফেনী থেকেই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকার অভিযোগে কিশোর গ্যাং-এর চার সদস্যকে আটক করা হয়। তারা কথিত ‘‘নুরু গ্যাং''-এর সদস্য৷ তাদের কাছ থেকে ছুরি ও চাকু উদ্ধার করা হয়।

পুলিশ জানায় প্রায় ১৫ বছর আগে ঢাকার উত্তরা এলাকায় কিশোর গ্যাং-এর তৎপরতা প্রথম নজরে আসে৷ এরপর তা আর কখনোই থামেনি। সেই কিশোর গ্যাং এখন ঢাকাসহ সারাদেশে এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। গত জুলাই মাসে পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা কিশোর গ্যাং পরিস্থিতি নিয়ে একটি বৈঠক করেন। তারা তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখেন যে কিশোর গ্যাং কালচার সারাদেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তারা বিশ্লেষণে দেখেন হত্যা থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই যাতে কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা জড়িত নয়। তাদের এই অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে। ওই বৈঠকে উপস্থিত একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ‘‘কিশোর গ্যাং গুলোর নেপথ্যে আছে প্রভাবশালীরা। বিশেষত রাজনৈতিক নেতা এবং হোয়াইট কলার ক্রিমিন্যালরা কিশোর গ্যাং-এর নেপথ্যে থাকে৷ তারা তাদের রাজনৈতিক শো-ডাউন থেকে শুরু করে নানা অপকর্মে এইসব গ্যাংকে কাজে লাগায়। অস্ত্র দেয়, অর্থ দেয়৷ ফলে গ্যাং-এর সদস্যরাও নিজেদের ক্ষমতাধর মনে করে এবং কাউকে পরোয়া করতে চায় না। জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধে।’’

পুলিশ সদর দপ্তর থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২২৫টি৷ ওই সদস্যরা আলাদা আলাদাভাবে ১১০টি গ্যাং-এর সদস্য৷ আর ১১০টি গ্যাং-এর সদস্য প্রায় এক হাজার৷ ওই সময়ে বিভিন্ন কিশোর গ্যাংয়ের ৫২৯ জন সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছে৷ কিশোর গ্যাং-এর সদস্যদের বয়স ১৩ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে৷

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তালিকাভুক্ত কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা ৫২টি৷ সদস্য সংখ্যা প্রায় ৭০০৷ ঢাকায় মিরপুরে এখন কিশোর গ্যাং সবচেয়ে বেশি৷ পুলিশের হিসাবে পুলিশের মিরপুর বিভাগে ১৩টি কিশোর গ্যাং-এর ১৭২ সদস্য সক্রিয়৷ কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা এলাকাভিত্তিক মাদকের কারবার, মাদকসেবন, মাদক সরবরাহ, ছিনতাই, ইভটিজিং, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি এমনকি খুনের মতো অপরাধেও জড়িত বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে৷

পুলিশের ওই বৈঠকে আগামী নির্বাচনে কিশোর গ্যাং সক্রিয় হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং প্রার্থীরা তাদের কাজে লাগাতে পারে৷ সেটা হলে পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে৷ গাজীপুর সিটিসহ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনে কিশোর গ্যাং-এর কদর দেখা গেছে৷

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপ পুলিশ কমিশনার মশিউর রহমান বলেন, ‘‘হতাশা আর হিরোইজম থেকে কিশোর গ্যাংগুলো তৈরি হয়৷ একেক এলাকায় কিশোর গ্যাং-এর প্রেক্ষাপট একেক রকম৷ অভিজাত এলাকায় উচ্চবিত্ত পরিবারের কিশোররা হিরোইজম থেকে কিশোর গ্যাং-এ যুক্ত হয়৷ আবার বস্তি বা নিম্নবিত্ত এলাকায় এটা হয় হতাশা থেকে৷ তবে এখানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউব তাদের প্রলুব্ধ করে৷ গ্রুপগুলো তাদের কাজের জন্য এই মাধ্যমগুলো ব্যবহারও করে৷’’

তার কথা, ‘‘এই কিশোর গ্যাংগুলো স্বাধীনভাবে গড়ে উঠলেও অনেক সময়ই স্থানীয় পর্যায়ের বড় অপরাধী, গডফাদার বা রাজনৈতিক নেতারা তাদের ব্যবহার করে৷ বিশেষ করে মাদক ব্যবসায়ী ও সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র তাদের কাজে লাগায়৷ এমনকি সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারী চক্রও তাদের ব্যবহার করে৷’’

তিনি বলেন, ‘‘আইন শৃঙ্খলার জন্য এই কিশোর গ্যাংগুলো উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ আর যদি আগামী নির্বাচনে তাদের স্থানীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীরা ব্যবহার করেন তাহলে তাও হবে উদ্বেগের বড় কারণ৷ এখন পর্যন্ত তাদের তেমন ব্যবহার করা হয়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য নেই৷ কারণ এই সময়ে যে নির্বাচনগুলো হয়েছে তাতে ভোটার তেমন ছিলো না৷ তবে তাদের ব্যবহার করা যায়৷ এটাই আশঙ্কার বিষয়৷’’

বাংলাদেশে কিশোর গ্যাং নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন৷ তিনি তার গবেষণার ওপর ভিত্তি করে ‘‘নন্দিত শৈশব এবং বাংলাদেশে কিশোর অপরাধ ও গ্যাং কালচার'' শিরোনামে একটি বইও প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ‘‘কিশোর অপরাধের ইতিহাস অনেক পুরনো। তবে সেই সময়ে তা সহনীয় পর্যায়ে ছিলো। এখন কিশোর গ্যাং গুলো হত্যাকাণ্ডসহ বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এর মূল কারণ পারিবারিক  শাসন এবং মূল্যবোধের ধস। একই সঙ্গে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি কিশোরদের অপরাধ ও অপরাধের কৌশলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে৷ এখানে তেমন নজরদারি নেই৷ আর তাদের জন্য খেলাধুলা ও বিনোদনের পরিসরও সীমিত হয়ে গেছে৷ ফলে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।’’

তার কথা, ‘‘এই কিশোরদের আবার সংঘবদ্ধ অপরাধীরা, হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা ব্যবহার করায় পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। কিশোরদের ভিতর এক ধনের হিরোইজম ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে৷ যা তাদের অপরাধে যুক্ত করছে।’’

তিনি মনে করেন, ‘‘সামনের নির্বাচনে এই কিশোর গ্যাংগুলোকে ব্যবহার করা হতে পারে। সেটা হলে এই গ্যাং আরো বাড়বে।’’

‘‘পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী একা এখানে কিছু করতে পারবে না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হবে। বয়ঃসন্ধিকালের এই কিশোরদের সবাই মিলে ঠিক মতো গাইড করতে হবে৷ তাদের সামনে ভালো উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের বিকাশের ভালো পরিবেশ দিতে হবে৷ তা না হলে এই কিশোর গ্যাং কালচার রোধ করা কঠিন,’’ মনে করেন এই অধ্যাপক।

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন: