পালিয়ে আসা বার্মিজ সীমান্তরক্ষীদের ভবিষ্যত কী? যা বলছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা
ছবি: বিজিবি’র হাতে আটক পালিয়ে আসা বার্মিজ সীমান্তরক্ষীরা
গেলো কয়েকদিন ধরে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলছে দেশটির সামরিক জান্তা বাহিনীর। তীব্র সংঘাতের মধ্যদিয়ে এরইমধ্যে দেশটির রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।
মধ্য জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিরোধের মুখে বান্দরবান সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মিয়ানমারের প্রায় ৩৫০ জান্তা সদস্য। যার অধিকাংশই দেশটির বর্ডারগার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্য পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশের পর তাদের নিরস্ত্র করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছে। চলছে তাদের নিজ দেশে পাঠানোর তোড়জোড়ও। মিয়ানমার সরকারের পক্ষ থেকে তাদের ফেরত নিতে জাহাজও পাঠানো হচ্ছে।
এই যখন পরিস্থিতি তখন বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠছে তাদের এতো সহজে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে। ২০১৭ সালে দেশটির অভ্যন্তরে রোহিঙ্গাদের চরম নির্যাতন করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলো সেখানকার জান্তা বাহিনী। সেই জান্তা বাহিনীতে ছিলো সেদেশের বর্ডারগার্ড পুলিশ (বিজিপি) সদস্যরাও। তাই রোহিঙ্গা নিধনে জড়িতদের এতো সহজে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না বলে মনে করছেন অনেকে। এছাড়া, সামরিক বাহিনীর এসব চৌকস সদস্যকে আশ্রয় দেওয়ায় বাংলাদেশ কোনো ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে কিনা সেটি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, এই সুযোগে দেশটির বাংলাদেশবিরোধী কোনো গুপ্তচরও প্রবেশ করেছে কিনা তা নিয়ে।
তবে দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই মুহূর্তে দুটি পথ খোলা রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের সামনে। এর মধ্যে সহজ পথটি হলো- বার্মিজ জান্তা সরকারের সাথে সমঝোতা করে তাদের সবাইকে নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া। অন্যটি হলো- বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের জান্তা সদস্যদের পরিচয় নিশ্চিত করে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা নিধনের ঘটনায় তাদের সম্পৃক্ততা রয়েছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা। প্রয়োজনে এই বিষয়গুলো আন্তর্জাতিক মহলের নজরে আনারও পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা জান্তা সদস্যদের বিষয়ে বাংলাদেশের করণীয় কী হবে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) নাঈম আশফাক চৌধুরী বাংলাভিশনকে বলেন, রোহিঙ্গা বা মিয়ানমার ইস্যু কোনো একটি দেশের বা শুধু বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের ঝামেলা নয়। এটির সঙ্গে অনেক স্টেকহোল্ডারের স্বার্থ জড়িত। এটি অনেকটা গ্লোবাল ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানকার ভূ-রাজনৈতিক অনেক বিষয়ে ভারত, চীন, আমেরিকার স্বার্থ জড়িত। মিয়ানমার এখন এদের ব্যাটলফিল্ডে পরিণত। আবার এখানে স্থানীয় গোষ্ঠীগুলোর নিজস্ব স্বার্থও আছে। তাই আমাদের দেখার বিষয়, সেখানে যারা যুদ্ধ করছে তাদের অবজেক্টিভ আমাদের সাথে মেলে কিনা বা রোহিঙ্গাদের পক্ষে যায় কিনা।
তিনি বলেন, যদি আমাদেরকে এই সমস্যার সমাধান করতে হয় তাহলে এই ইস্যুতে জড়িত সব স্টেকহোল্ডারকেই যুক্ত করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এখানকার বড় স্টেকহোল্ডার বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যোগাযোগ বা সমন্বয় করতে পারবে কিনা। চিরাচরিত ডিপ্লেমেসি অনুযায়ী পারার কথা না। তাছাড়া তাদের যে যুদ্ধের লাইনআপ সেটাতো ভারতীয় স্বার্থের বিপরীতে কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে আরাকান আর্মির সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ স্থাপন করা কতোটুকু ঠিক হবে তা কূটনীতিকরা ভালো বলতে পারবেন। কিন্তু যদি আমাদের লং টার্মের কথা চিন্তা করি অর্থাৎ রোহিঙ্গারা সেদেশে ফিরে যাবে এবং তাদের সাথে সহাবস্থান করতে হবে। এজন্য আমাদের একটা প্ল্যাটফর্ম দরকার যেটার মাধ্যমে স্টেট (মিয়ানমার সরকার) এবং নন স্টেট (স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী) উভয়ের সঙ্গে যোগাযোগ বা সমন্বয় করা যাবে। এটা ট্র্যাক ওয়ানে না পারলে ট্র্যাক টু বা ট্র্যাক টু পয়েন্ট ফাইভ হলেও করা দরকার। যেটা একটি ক্রেডিবল প্ল্যাটফর্ম হবে, যার মাধ্যমে সমাধান খোঁজা যাবে।
এই নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, এখন আমাদের দেশে যারা পালিয়ে চলে আসছে তারা কারা এটাও খতিয়ে দেখতে হবে। এখন আমাদের একটা সুযোগ রয়েছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আমরা যে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলে স্থানীয় জনগণের বিপক্ষে গিয়ে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ করেছি সেটার কিছু স্টেটমেন্ট সংগ্রহ করার অনেক সুযোগ আছে। আমরা এদের কাছ থেকে সেটা নিতে পারি। তাদের চলমান ক্রাইসিস থেকে আমরা কিভাবে বেনিফিট নিতে পারি সেটা নিয়ে আমাদের এখনই ভাবা প্রয়োজন। তবে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে এদের বিচার করার কথা বললেও আমি মনে করি, যুদ্ধাপরাধের জন্য এই কয়েকজনের বিচার করে কোনো লাভ নেই। বরং রোহিঙ্গাদের ভাবতে হবে তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার এবং সেখানে সহাবস্থানের বিষয়ে। সেটি করতে হলে এ কয়েকজনের বিচার চেয়ে কোনো লাভ নেই, তবে এদের মাধ্যমে সেই সময়ের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ সংগ্রহ করা যেতে পারে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল’ এন্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান বলেন, এরা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনকারী এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আমরা যদি এদেরকে রোহিঙ্গাদের হাতে তুলে দেই তাহলেতো আরও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। এরা মিয়ানমার সরকারের বেতনভোগী কর্মচারি। তারা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যা করেছে তা তাদের সরকারের নির্দেশে করেছে। তারা এখন আমাদের দেশে জীবন বাঁচাতে এসেছে। এখন তাদের বিচার করার দায়িত্ব আমাদের নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমাদের উচিত হবে তাদেরকে একটি চুক্তির মাধ্যমে নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া।
অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এদের বিচার করার কোনো এখতিয়ার আমাদের নেই। যেহেতু তারা আমাদের দেশে ঢুকে পড়েছে এখন তাদেরকে নিরাপদে দেশে পাঠানো আমাদের দায়িত্ব বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মোজাহিদুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এদের তুলনা করা যাবে না। প্রায় ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গাকে আমরা আশ্রয় দিয়েছি মানবিক কারণে। এখন যারা আসছে তারা এসেছে মিয়ানমারের ভেতরের বিবাদমান পরিস্থিতির কারণে। এটা খুবই ছোট একটা সংখ্যা। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের যে সম্পর্ক সেটাকে যদি আমরা বিবেচনা করি তাহলে উচিত হবে তাদের সরকারের সঙ্গে একটা চুক্তি করে এদেরকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো। যতোদিন পর্যন্ত চুক্তি না করবে ততোদিন তাদেরকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে কাস্টোডিতে রাখতে হবে। কারণ যদিও তারা যুদ্ধের কারণে আশ্রয় নিতে এসেছে তবে এরা অবৈধভাবে আমাদের দেশে ঢুকেছে। এক্ষেত্রে আমাদের আইনে যা আছে সে অনুযায়ী তাদের সঙ্গে আচরণ করে চুক্তি হওয়ার পর ফেরত দিতে হবে।
মিয়ানমারের বর্তমান ইস্যুকে খুবই জটিল মন্তব্য করে তিনি বলেন, যেহেতু সেখানকার বিদ্রোহীরা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে সফলতা পেয়ে যাচ্ছে তাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ বিষয়ে খুবই টেকনিক্যাল হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, এখন যারা পালিয়ে এসেছে তারা রোহিঙ্গা নির্যাতনে দায়ী থাকলেও এরা একেবারে মাঠ লেভেলের কর্মকর্তা-কর্মচারি, এদের উপর চাপ সৃষ্টি করে কোনো লাভ হবে না। তাই মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে তাদের ফেরত দিতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি এমনভাবে হতে হবে, আমরা যাই করি না কেনো তার মাধ্যমে কিছু আয় করতে হবে। এখন যে তাদের আমরা চুক্তির মাধ্যমে ফেরত দিবো এতে তাদের সরকারের কাছেও আমরা কিছু প্রত্যাশা করতে পারবো। আবার প্রত্যাশা করা বলতে এই নয় যে, এখনই তাদের কাছে আমরা কিছু চাচ্ছি। এদের ফেরত দিয়ে বুঝাতে হবে যে, আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে আছি, তারাও যেন আগামীতে এই সৌহার্দ্যটা ধরে রাখে। আগামীতে আমরা কিছু প্রত্যাশা করলে যেনো সেটা রাখে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বিপদে পড়ে তারা আশ্রয় নিতে এসেছে এদের ধরে বিচার করা বা বিচার চাওয়া কোনো কূটনৈতিক ভাষা হতে পারে না। এটার কোনো সুযোগও নেই, এটা করলে হবে হঠকারী সিদ্ধান্ত। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আশ্রয় দিতে হয়, বাংলাদেশ মানবিকতা এবং বন্ধুসূলভ আচরণ দেখিয়ে সেটি করেছে। এদের জিম্মি করা একটা সভ্য রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভব নয়। এগুলো করতে পারে জঙ্গি গোষ্ঠী, আমরাতো একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, জঙ্গি গোষ্ঠী নয়। তাই আমি মনে করি তাদের ফেরত দেওয়াই আমাদের একমাত্র দায়িত্ব।
মিয়ানমার এখন বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মন্তব্য করে সীমান্তে আরও কড়া নজরদারি বাড়ানোরও পরামর্শ দেন এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক।
বিভি/এমআর
মন্তব্য করুন: