আজ পরিযায়ী পাখি দিবস
ফুলে-ফলে সুশোভিত করেও বিলুপ্তির ঝুঁকিতে ৩৩ প্রজাতির পাখি
								
													যেসব প্রাকৃতিক উপাদান সুজলা-সুফলা বাংলাদেশকে এত রূপ দিয়েছে তার মধ্যে পাখি অন্যতম। নানা প্রজাতি আর নানা বর্ণের পাখির কলরবে সারাক্ষণ বাংলার প্রকৃতি থাকে মুখরিত। কণ্ঠ-মাধুর্যে যুগ যুগ ধরে দেশের মানুষের মনোহরণ করে আসছে এই পাখি। এখানে আকাশের সূর্য তার আগমনী বার্তা দেওয়ার আগেই পাখি তার মধুর কণ্ঠে স্বাগত জানায় দিনের প্রথম প্রহরকে। এখনও দেশের সর্বত্রই রয়েছে পাখিদের পদচারণা।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ও বাংলাদেশ বন বিভাগের সর্বশেষ তথ্য বলছে, দেশে ৭১১টি প্রজাতির পাখির বিচরণ দেখা যায়। যার মধ্যে ৩৮৮ প্রজাতিই পরিযায়ী পাখি। এর মধ্যে শীতে ২০০ প্রজাতি, গরমে ১১ প্রজাতির পাখি আসে। 
দেশে আসা পরিযায়ী পাখির মধ্যে ২৪ প্রজাতির পরিযায়ী হাস, শিকারী পাখি ৩২, মাঝে মাঝে ভ্রমণকারী ১৬৫ এবং ১২ প্রজাতির পাখি শুধু রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করে।
২০১৯ সালের পাখি শুমারি বলছে, প্রতি বছর হাওর অঞ্চলে আসে দেড় থেকে ২ লাখ পরিযায়ী হাস, উপকূলে আসে ৪০-৫০ হাজার সৈকত পাখি, নদীর চরে ১০-১৫ হাজার পরিযায়ী পাখি।
আইইউসিএনের পাখির বিচরণ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, মঙ্গলিয়া, চায়নাসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আমাদের দেশে পাখি আসছে। এরা ক্ষেত্রভেদে ২০০ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশে বিচরণ করে। বিশেষ করে দেশের হাওর ও চরাঞ্চলগুলোতে সবচেয়ে বেশি পাখি বিচরণ করছে। পরিযায়ী পাখিদের শতকরা ৮০ শতাংশ পাখি জলাভুমিকে কেন্দ্র করেই আসে। সংস্থাটির ২০১৬ সালের তথ্য বলছে, সে বছর ৭৩ হাজার টন প্রাকৃতিক মাছ উৎপাদন হয়েছে হাওরে। যার সংগে কোনো না কেনোভাবে পাখির সম্পৃক্ততা ছিল। তাছাড়া, ধানসহ ফসল উৎপাদনে বড় ভূমিকা থাকে এই পাখিদের।
আইইউসিএন-এর সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে পাখির বিচরণ পর্যবেক্ষণ করে আসছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক। বাংলাভিশনকে তিনি বলেন, বিভিন্ন মৌসুমে বাংলাদেশে আসা পাখিরা আমাদের খাদ্য উৎপাদন, অক্সিজেনের যোগান দেওয়াসহ নানানভাবে মানুষের জন্য ভূমিকা রাখে। কিন্তু পাখিরা আমাদের কি উপকার করে আমরা তা হয়তো খালি চোখে দেখি না বলে এক ছটাক মাংসের আশায় তাদের বিপন্ন করে দেই।
তিনি বলেন, পাখিরা আমাদের ফসলের পরাগায়ন করে, ক্ষতিকর পোকা নিয়ন্ত্রণ করে এবং বীজ ছিটিয়ে প্রাকৃতিক বনায়নে ভূমিকা রাখে। আমরা যদি সুন্দরবনের কথা চিন্তা করি, সেখানে প্রচুর প্রায় সব গাছের পাতায়ই ছোট ছোট ফুটা দেখতে পাবেন। এগুলো সেখানে থাকা লাখ লাখ পোকা করেছে। তারা গাছগুলোকে নষ্ট করে দেয়। কিন্তু আমরা কি কখনো সুন্দরবনে কিটনাশক দিয়েছি? তাহলে সেখানকার পোকা নিয়ন্ত্রণ করছে কে? একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, পাখিরা পোকা খেয়ে বন রক্ষা করছে। এভাবে আমাদের ফসলও রক্ষা করে। তাছাড়া, এদের বিষ্ঠা জমির সার হিসেবে কাজ করে। যা আমরা টাকায় কিনে দিয়ে কখনো পূরণ করতে পারতাম না।
এখন বাড়তি ফসল উৎপাদনের জন্য আমরা কীটনাশক দিয়ে পোকা নিয়ন্ত্রণ করি। কিন্তু এটা করতে গিয়ে বিষ খেয়ে নিজেরাও ক্ষতিগ্রস্ত হই, টাকাও খরচ হয়। অথচ পাখি কোনো ধরনের খরচ ছাড়া সম্পূর্ণ নিরাপদ পদ্ধতিতে পোকা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের পৃথিবীকে ফুলেফলে সাজিয়ে রাখে। তাই পাখি সংরক্ষণে সবাইকে সচেতন হতে বলেন এই পাখি বিশেষজ্ঞ।
যদিও তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশে বিচরণকারী পাখিগুলোর মধ্যে ৩৯টি প্রজাতির পাখি সংকটাপন্নের তালিকায় আছে যার মধ্যে ২১টি পরিযায়ী পাখির প্রজাতি রয়েছে। গেল ১২ বছরের জরিপ থেকে আইইউসিএন বলছে , নানা কারণে দেশে বিচরণকারী অন্তত ৩৩ ভাগ পাখি এখন চরম হুমকির মুখে রয়েছে।
গত ২০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে আইইউসিএন আরও বলছে, দেশে অন্তত ৩৮ শতাংশ পাখি আভাসস্থল বিলুপ্ত হয়েছে। এর মধ্যে পাখির অন্যতম আভাসস্থল হাকালুকি হাওরে বিলুপ্ত হয়েছে অন্তত ৪৫ শতাংশ আভাসস্থল।
গত ১০ বছরে টাঙ্গুয়ার হাওরে ৩০-৪০ ভাগ হাস খামার ও ৩৫ ভাগ গবাদি পশুর খামার বেড়েছে বলে জানিয়ে এটিকে পরিযায়ী পাখিদের আবাস বিলুপ্তির অন্যতম কারণ হিসেবেও চিহ্নিত করা হয় গবেষণায়। একইসংগে প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে দেশজুড়ে ক্রমবর্ধমান জলাভূমি কমে যাওয়াকেও পাখির জন্য হুমকি বলে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বন অধিদফতরের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক মোল্ল্যা রেজাউল করিম বাংলাভিশনকে বলেন, পরিযায়ী পাখি আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য একটা বড় সম্পদ। এদের জন্য প্রকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা ও মানুষকে সচেতন করা খুবই জরুরি। আমারা চাই মানুষের মনের মধ্যে পাখির জন্য একটা জায়গা তৈরি করতে। যেন তারা এই পাখিগুলো রক্ষায় নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসে।
তিনি বলেন, বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ অঞ্চলের বন সংরক্ষক হিসেবে আমি যেটা বলতে পারি, জনসম্পৃক্ততা বাড়নোর মাধ্যমে আমরা আগের মতো পাখি হত্যা বন্ধ করতে পারলেও তাদের আবাসস্থলের নিরাপত্তা দিতে পারছি না। দেশে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে স্থাপনা নির্মাণ করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক ভূমি কমছে। ফলে শুধু পাখি নয়, সব বন্যপ্রাণীরাই হুমকির মুখে। প্রাণীদের আবাসস্থল রক্ষা করাই আমাদের কাছে এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা করছি বন্যপ্রাণীদের আবাসস্থল রক্ষার। পাশাপাশি বন্যপ্রাণীদের জন্য মানুষের মনে একটু জায়গা করে দিতেও জোর চেষ্টা চালাচ্ছি যাতে সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে এদের রক্ষায় এগিয়ে আসে।
বিভি/কেএস
বিভি/কেএস
						


							
							
 
										
							
							
							
							
							
							
							
							
							
							
											
											
											
											
মন্তব্য করুন: