• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪

অভিযুক্ত ভিয়েতনামী নারিকেলে অবিশ্বাস্য ফলনের খবর!

কেফায়েত শাকিল, পটুয়াখালী থেকে ফিরে

প্রকাশিত: ১৯:৪৩, ১৮ আগস্ট ২০২২

আপডেট: ১৭:১২, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

ফন্ট সাইজ

নারিকেল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৩ সালে দেশে ভিয়েতনামী নারিকেলের চারা আনে কৃষি বিভাগ। খাটো জাতের এই নারিকেলে অল্প সময়ে বেশি ফলন হবে বলা হলেও এই গাছ লাগিয়ে বহু কৃষকের সর্বশান্ত হওয়ার গল্প উঠে এসেছে গণমাধ্যমে। দেশজুড়েই এই প্রজাতির নারিকেল চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষকরা। তবে সেই অভিযুক্ত ভিয়েতনামী নারিকেলেই ভালো ফলন এসেছে বলে দাবি করেছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর।

সংস্থাটি জানায়, ভিয়েতনামী নারিকেল গাছের বাগান করে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত সর্বদক্ষিণের জেলা পটুয়াখালীর অজপাড়া গাঁয়ের কৃষক মো. মহসিন সফলতা পেয়েছেন। তার বাগানে থোকায় থোকায় ধরেছে নারিকেল। এই দাবির সত্যতা যাচাইয়ে আমরাও যাই সেই বাগানে।

পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার বাটুয়া এলাকার মো. মহসিনের নারিকেল বাগানে গিয়ে দেখা যায়, জোয়ারে প্রায়ই পানি উঠে এই বাগানে। আবার নেমে যায় ভাটার সময়। বাগানটিতে নারিকেলে ভরপুর দেখা যায় প্রতিটি গাছ। গাছপ্রতি গড়ে নারিকেল পাওয়া যায় ৬০ থেকে ১শ’টি পর্যন্ত। নারিকেলগুলো বেশ বড় এবং সুমিষ্টও। কেটে পানি পাওয়া যায় ৪ থেকে ৫ গ্লাস পর্যন্ত। 

বাগান মালিক মহসিন একজন সারের ডিলার। তবে এখন তার আয়ের প্রধান উৎস্য এই নারিকেল বাগান। তিনি জানান, ২০১৬ সালে ৫শ টাকা দরে ভিয়েতনামী খাটো জাতের ১০০টি নারিকেলের চারা সংগ্রহ করে নদীর পাড়ে এই বাগান করেছিলেন তিনি।  বর্তমানে নারিকেল বা ডাব বিক্রির পাশাপাশি প্রতিমাসে শুধু চারাই বিক্রি করেই আয় করেন লাখ টাকার বেশি। 

মো. মহসিন বাংলাভিশনকে বলেন, প্রথমে ইন্টারনেটে দেখতে পাই ভিয়েতনাম থেকে নারিকেলের চারা আনা হচ্ছে। আমি সেখানে দেওয়া নম্বরে যোগাযোগ করে ঢাকার খামারবাড়ি থেকে চারা এনে এই জমিতে লাগাই। শুধু নারিকেল চারা লাগিয়েছি দেড় লাখ টাকার। নারিকেল গাছের সঙ্গে কলা গাছও লাগিয়েছিলাম। প্রথম বছর কলা বিক্রি করেছি ৫ লাখ টাকার মতো। এতে জমির খরচ উঠে গেছে। আড়াই বছর পর থেকে নারিকেল ধরা শুরু করে। নারিকেল গাছের খরচও উঠে গেছে। এখন আমার কাছে প্রায় ২ হাজার চারা আছে গাছেও বেশ ডাব আছে। প্রতিটি চারা ৫শ’ করে বিক্রি করছি। এখন আর কোনো খরচ নাই, এখন থেকে নারিকেল ও চারা যাই বিক্রি করবো সব আমার লাভ।

কি পরিচর্যা করেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, তেমন একটা পরিচর্যা করাই হয় না। প্রতিদিন জোয়ারের পানিতো আসছেই। পাশাপাশি বছরে এক-দুবার সার দেই। আর গাছের ঢালগুলো ছেটে দেই এটুকুই। 

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘কলাপাড়া উপজেলায় আমরা আরও বেশ কয়েকজন কৃষককে এই জাতের চারা দিয়েছাম। কিন্তু অধিকাংশ কৃষকই সফলতা পাননি। এর বড় কারণ হিসেবে আমরা মনে করছি পানির অপর্যাপ্ততা। নদীর পাড়ের এই বাগারে সফলতা দেখে আমরা এখন সবাইকে পানির আশপাশে নারিকেল গাছ লাগাতে বলছি। এখন অনেকেই এই পরামর্শ কাজে লাগাচ্ছে। প্রতিদিনই চারার চাহিদা তৈরি হচ্ছে, আমরা সবাইকে মহসিন সাহেবের কাছে পাঠাচ্ছি।

ভিয়েতনামী এই নারিকেল চাষে আগ্রহীদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে বলেও দাবি করেন এই কৃষি কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, দেশে ভিয়েতনামী এই নারিকেল আনা হয় কৃষি সম্প্রসারণের অধিদফতরের পরিচালিত বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে। দেশজুড়ে ব্যর্থ এই প্রজাতি পটুয়াখালীতে কিভাবে ভালো ফলন দিলো জানতে চাইলে প্রকল্পটির পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদ বলেন, সারা দেশ থেকে প্রচুর অভিযোগ পেয়েছি ভিয়েতনামী নারিকেল গাছ লাগিয়ে লসে পড়েছেন এমন অনেকে অভিযোগ করেছেন। আমরা বার বার বলেছি, যথাযথ পরিচর্যা ও প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো পর্যাপ্তভাবে দেওয়া গেলে অবশ্যই সুফল আসবে। মহসিন সাহেব সেটাই প্রমাণ করেছেন। তবে তার এখানে অধিকাংশ উপাদান প্রকৃতিকভাবেই এসেছে।’

আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমরা জানি যে নারিকেলের জন্য চারটা জিনিস খুবই অপরিহার্য। প্রতিদিন পানি সরবরাহ দরকার। এখানে সেটা জোয়রের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবেই আসছে। আর সমুদ্র উপকূলের পানিতে যেহেতু ক্লোরিন ও লবন থাকে সেটা নারিকেলের জন্য খুবই উপকারী। আবার নারিকেল যেহেতু তেল জাতীয় গাছ এর সালফার খুবই প্রয়োজন। আমাদের দক্ষিণাঞ্চলের মাটিতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সালফার রয়েছে এর কারণেই এই বাগানটি সফল হয়েছে বলে আমি মনে করি।’

গাছকে দোষ না দিয়ে যথাযথ পরিচর্যা করলে সুফল আসবে বলে দাবি করে এই কৃষি কর্মকর্তা বলেন, ‘নারিকেল গাছে সাদামাছি নামের পোকার আক্রমন ঠেকাতে ফিজিমাইট, ফাইটোক্লিন বা ইমিটাব ও সালফার দুটো মিশ্রন করে প্রতি ১৫ দিন পর স্প্রে করতে হবে। এটা করলে গাছ তার যথাযথ পুষ্টি উপাদান কাজে লাগাতে পারবে ভালো ফলন দিবে।’

গরমের আরাম ডাবের পানি। শরীরের পানিশূন্যতা পূরণসহ নানা রোগের প্রতিষেধক এই পানি। যা পানে মুহূর্তে শরীরে এনে দেয় সজীবতা। পুষ্টিবিদরা বলেন, প্রতি ১০০ গ্রাম নারিকেলে আছে ৩৫৪ ক্যালরি, ৩৩ গ্রাম ফ্যাট, ২০ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ৩৫৬ মিলিগ্রাম পটাশিয়াম, ১৫ গ্রাম কার্বোহাইড্রেট ও ৩.৩ গ্রাম প্রোটিন। এছাড়াও ভিটামিন সি, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি-৬ ও বি-১২ আছে। যা শরীরের শক্তি বৃদ্ধি, হার্ট সুস্থ রাখা, ওজন ও ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ এবং ক্যান্সারের মতো রোগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। এছাড়া ত্বক কোমল রাখা, হজমশক্তি বাড়ানো, দাঁত ও চুল মজবুত রাখাসহ বহু রোগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে নারিকেল।

ব্যাপক পুষ্টিগুণসম্পন্ন এবং খাবার বা প্রশাধনীসহ বহুবিধ ব্যবহার থাকায় যুগ যুগ ধরেই ব্যাপক চাহিদা রয়েছে নারিকেলের। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্যমতে দেশে খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে প্রায় ৩৫ কোটি নারিকেলের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু উৎপাদন হয় মাত্র ১০ কোটি নারিকেল। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় ৩ ভাগের একভাগেরও কম। তাই এই ফলের বাণিজ্যিক উৎপাদনের উদ্যোগও চলছে বছরের পর বছর ধরে। 

বিভি/এনএ

মন্তব্য করুন: