ম্যাজিক্যাল যে ভবনের গল্প সাহস যুগিয়েছিলো
ঊনপাঁজুরের মতোই হতভাগ্য ঊনপঞ্চাশ তলা ভবন। নির্মাণের চার বছর পর শনাক্ত হলো ফাউন্ডেশনের ত্রুটি! বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়া সবার ঘুম হারাম। কন্ট্রাক্টরের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার চলছে। মামলা মোকদ্দমায় গড়ালো সাধের বিলিয়ন ডলার চুক্তি। কন্ট্রাক্টরের জরিমানার কিছু ডলার না হয় ফেরত এলো। কিন্তু ভবন তো বাঁচাতে হবে!
ভবন বাঁচানোর জটিল কাজটায় কিভাবে যেন যুক্ত হয়ে গেলাম। ফাউন্ডেশনের স্ট্রাকচারাল রিমেডিয়েশন চললো তিনমাস ধরে। আতংকে ছিলাম সাফল্য নিয়ে। সফলতার পেছনে সাহস যুগিয়েছিলো টরন্টো মহানগরীর ৪৮৮ ইউনিভার্সিটি এভিনিউস্থ বহুতল ভবন।
ব্যক্তিগত আগ্রহের জায়গা থেকে ভবনটির নির্মাণ কাহিনী খুঁজে বের করেছিলাম। প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করার এক চ্যালেঞ্জিং গল্প। পুরনো ১৮ তলা ভবন না ভেঙে বরং এটাকেই ৫৫ তলায় উন্নীত করা যে কোনো মানুষের কাছেই অবাস্তব এবং অনিরাপদ। এমনকি অনেক আর্কিটেক্ট সাহেবও একে গাঁজাখুরি ভাবতে পারেন।
কিন্তু গণিতে সিদ্ধহস্ত স্ট্রাকচারাল এবং জিওটেকনিক্যাল প্রকৌশলীরা এটি বাস্তবে রূপদান করেছেন। এক্সিস্টিং ভবনের ফাউন্ডেশন ট্রিট করে ব্রেসিং পদ্ধতিতে স্ট্রাকচারাল বিন্যাস পরিবর্তন করেছেন কয়েকজন জাঁদরেল প্রকৌশলী। টরন্টোর বুকে নিরাপদ ৫৫ তলা ভবন সগর্বে দাঁড়িয়ে এর সাক্ষ্য দিচ্ছে।
প্রথমবারের মতো বিষয়টি যখন পত্রিকায় উপস্থাপন করি তখন শিরোনাম দিয়েছিলাম ‘পঞ্চান্নে লুকিয়ে থাকা বিস্ময়’। শিরোনাম দেখে অনেকের হয়তো মনে হয়েছিলো এটি স্বাস্থ্য বিষয়ক আলোচনা। স্বাস্থ্য বা হেলথ নিয়ে আলোচনা খানিকটা আছে। তবে মেডিক্যাল হেলথ নয়, বরং ইঞ্জিনিয়ারিং হেলথ। ইঞ্জিনিয়ারিং পরিভাষায় ইংরেজিতে একে বলে স্ট্রাকচারাল হেলথ মনিটরিং টেকনোলজি। প্রতিনিয়ত বিভিন্ন লোডিং-এর ফলে একটি ভবন বা ব্রিজের স্ট্রাকচারের ভেতর কি রকমের স্ট্রেস এবং স্ট্রেইন হচ্ছে তা মনিটর করার নাম স্ট্রাকচারাল হেলথ মনিটরিং।
অবশ্য এ প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হলে ভবন নির্মাণের শুরুতেই সাধারণ রডের পরিবর্তে ফাইবার রিইনফোর্সড পলিমার বা এফআরপি ব্যবহার করা হয়। ডাটা সংগ্রহের জন্য কংক্রিটের ভেতর প্রচুর ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস বসানো হয়। আধুনিক ভবন, ব্রিজ, বাঁধ বা গ্যাসপাইপ লাইন মনিটর করার জন্য ওয়্যারলেস টেকনোলজি ব্যবহার করে প্রতি মুহূর্তে এদের স্ট্রাকচারের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন বা ক্ষয় চেক করা হয়। পর্যবেক্ষণের জন্য একটি প্রকৌশল টিম সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকে।
যাহোক, ম্যাজিক্যাল যে ভবনের গল্প সাহস যুগিয়েছিলো সেটি ১৯৬৮ সালে নির্মিত পুরনো ১৮ তলা ভবন। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সেন্ট জর্জ ক্যাম্পাসের সামান্য দূরে এর অবস্থান। বিশ্বখ্যাত শিশু হাসপাতাল টরন্টো সিক কিডস এই ভবনের কাছাকাছি। চারিদিকে কেবল গুরুত্ত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ভবন। আছে কোর্ট ভবন, ইন্স্যুরেন্স ভবন, বিখ্যাত ব্র্যান্ডের হোটেল ইত্যাদি। এমন লোকেশনে মাত্র ১৮ তলা ভবন?
রিয়েলটর আর ডেভেলপারদের কমার্শিয়াল দৃষ্টি এড়ালো না। ডাউন টাউনের গরম রিয়েল এস্টেট বাজারে প্রতি বর্গফুট স্পেসের দাম হাজার দেড়েক কানাডিয়ান ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় লাখ টাকার উপরে। আহা... এই জায়গায় যদি সত্তর আশি তলা ভবন বানানো যেতো! তাহলে বাকি তলাগুলোর বিক্রয় কমিশন কতো আসতো? হিসেব কষতে কষতে সওদাগরি চোখগুলো চকচক করে ওঠে!
২০১০ সালের দিকে রিয়েলএস্টেট কর্পোরেশনগুলো মরিয়া হয়ে ছুটলো এর পেছনে। কর্পোরেট ঘোড় দৌড়ে শেষতক স্বর্ণ জিতলো স্বল্পখ্যাত ডেভলপার এমেক্সন কর্পোরেশন। এমেক্সন ভবন কর্তৃপক্ষকে রাজি করিয়েই ছাড়লো। শর্ত থাকলো পুরাতন ভবন ভেঙে নতুন বানাবে, নয়তো পুরনো ভবনকে ঊর্ধ্বাকাশে টেনে তুলবে। কিন্তু ঊর্ধ্বাকাশে... মানে ১৮ তলা বিল্ডিংকে স্কাইস্ক্রাপার বানাবে কী করে?
চেষ্টা করতে দোষ কী? এমেক্সন কর্তারা বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী খুঁজতে লাগলেন। স্ট্রাকচারাল ফরেনসিক এক্সপার্ট খুব বেশি নেই টরন্টোতে। উচ্চ অংকের ফি দিয়ে সিভিল ফরেনসিক প্রকৌশল পরামর্শ কিনতে হয়। ডেভেলপারদের অর্থের অভাব নেই। বিশেষজ্ঞ পেতে বিশেষ বেগ পেতে হলো না।
স্ট্রাকচারাল ফরেনসিক ইঞ্জিনিয়াররা ইন্সপেকশনে নেমে পড়লেন। সম্ভবত ২০১২/১৩ সালের কথা। ভবনের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে প্রকৌশলীরা নিশ্চিত হলেন ফাউন্ডেশন সহ কাঠামোগত দিক থেকে ভবনটি বেশ শক্তিশালী। প্রাথমিক সমীক্ষা শেষ করে তাঁরা জানালেন ১৮ তলা ভবনটি না ভেঙে এটি উপরের দিকে বৃদ্ধি করা সম্ভব।
রিপোর্ট পেয়ে বেজায় খুশি ডেভেলপার। হীরের খনি এই জমি। আবার একটি ভবনের ১৮তলা রেডিমেড পাওয়া যাবে। বাকিটা নির্মাণ করতে পারলেই বিরাট অংকের মুনাফা।
বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকে ডেভেলপার এমেক্সন কর্পোরেশন। বাণিজ্যিক সুবিধা এবং এলাকার শোভাবর্ধন, দুটো জিনিস মাথায় রেখে তাঁরা স্মরণাপন্ন হলেন প্রখ্যাত আর্কিটেকচারাল ফার্ম ‘কোর আর্কিটেক্ট’-এর।
প্রাথমিক সমীক্ষা রিপোর্ট দেখিয়ে কোর আর্কিটেক্টের কাছে এমেক্সন জানতে চাইলো, উপরে কতো তলা পর্যন্ত বাড়ানো যাবে? কোর আর্কিটেক্ট জানালো, এটি প্রকৌশলীদের বিষয়। তাঁরা বলতে পারবেন। কারণ ভবনের নীচে মাটির বিয়ারিং ক্যাপাসিটি কতো তা আমরা জানি না। ফাউন্ডেশন কাঠামো এবং উপরিকাঠামো বাড়তি চাপ কতোটা সইতে পারবে সেসব আমাদের অজানা। এগুলো হিসেব করে বের করার দায়িত্ত্ব পুরকৌশলী বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের। সুতরাং পুনরায় ভবন পরীক্ষা করে তাঁরাই বলতে পারবেন কতো তলা বাড়ানো যাবে।
এবার প্রকৌশলী খোঁজার পালা। নগরীর নামকরা প্রকৌশল পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সিগমন্ড সুদাক অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস। মিসিসাগার টুইস্টিং মেরিলিন মনরো টাওয়ার (যা এখন এবসোলিউট টাওয়ার নামে পরিচিত) ডিজাইন করে তাঁরা বিশ্বব্যাপী খ্যাতি পেয়েছেন। প্রায় অর্ধশত বছরের পুরোনো ১৮তলা ভবনকে মাঝখানে রেখে নতুন মোড়ক লাগিয়ে বহুতল ভবন বানানো চাট্টিখানি কথা নয়। বিশ্বে এমন নির্মাণ রেকর্ড খুঁজে পাওয়া যায় না। বিশাল চ্যালেঞ্জ! সেই চ্যালেঞ্জ সিগমন্ড সুদাক গ্রহণ করলেন। তাঁর প্রকৌশল টিম দিনরাত পরিশ্রম করে বিশাল এনালাইসিস রিপোর্ট বানালেন। গাণিতিক বিশ্লেষণে তাঁরা পূর্ণ নিরাপত্তায় ভবনটিকে ১৮ তলা থেকে বাড়িয়ে ৫৫ তলায় উন্নীত করার ঘোষণা দিলেন। অর্থাৎ বাড়তি ৩৭ তলা নির্মাণ করা হবে বর্তমান ১৮ তলা ভবনের উপর।
২০১৫ সালে ডিটেইল ডিজাইন করা হলো। এবছরেই নির্মাণ শুরু। পুরোনো ভবনের নিচে যে পাইলিং ছিলো তা ৫৫ তলা ভবনের লোড বহনের উপযুক্ত ছিলোনা। কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থায় মেকানিক্যাল সাপোর্টে ভবন সুরক্ষিত রেখে পাইলের মাথা উম্মুক্ত করা হয়। এর উপর বেসমেন্ট পার্কিং লটের স্ল্যাব ঢালাই দেওয়া হয়।
চারিদিকের গ্রেড বিমের নিচে আন্ডারপিনিং পদ্ধতিতে নতুন করে ফাউন্ডেশন দেওয়া হয়। এরপর ব্রেসিং পদ্ধতিতে ৫৫ তলা ভবনের লোডের বেশিরভাগ অংশ চারদিকের গ্রেড বিমের উপর ট্রান্সফার করা হয়। উপরের প্রতি তলার কলাম ও বিমের ক্ষেত্রেও ব্রেসিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে লোডের বেশিরভাগ অংশ বহির্ভাগে ট্রান্সফার করা হয়। যদিও জ্যামিতিকভাবে যে কোনো বস্তুর লোড তার কেন্দ্র বরাবর গমন করে। কিন্তু এই ভবনের প্রকৌশলীরা বিশেষ টেকনিকে লোডকে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে ফেলেন।
পুরকৌশল বা সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পুরোনো মধ্যমতল ভবনকে উচ্চতলে পরিণত করা প্রায় নজিরবিহীন।
মহানগরীর ৪‘৮৮ ইউনিভার্সিটি এভিনিউ’র উপর অবস্থিত ১৮ তলা ভবনটিকে ৫৫ তলায় উন্নীতকরণ শেষ হয় ২০১৯ সালের শেষদিকে। তখন ভবনের মূল ফাউন্ডেশনের বয়স ৫১ বছর। অর্ধ শতাব্দী পার করা একটি ১৮ তলা ভবনের ৫৫ তলায় এক্সটেনশন এক পরম বিস্ময়। কানাডার প্রকৌশলীরা তা পেরেছেন।
কানাডাপ্রবাসী প্রকৌশলী হাসান জামান খান-এর ফেসবুক থেকে নেওয়া
বিভি/এসডি
মন্তব্য করুন: