সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতি নয়, প্লিজ …

ছবি: ফাইল ফটো
স্বাধীনতার একান্ন-বায়ান্ন বছরেও শুনতে হয় সংখ্যালঘু শব্দটি। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অধিকতর পছন্দের দল আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদ ক্ষমতায়। এর পরও পূজা-পার্বণে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তাহীনতা দুঃখজনক, অগ্রহণযোগ্য। সামনে নির্বাচন। এর আগে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় আয়োজন দুর্গোৎসব। এবার দেবী দুর্গার আগমন ও গমন হবে ‘ঘোটকী’। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দেবীর এ ধরনের আগমন ও গমনকে চরম অশুভ ভাবে। শঙ্কা করে প্রকৃতি বা মনুষ্য সৃষ্ট দুর্যোগের।
আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে শুক্রবার (২০ অক্টোবর) ঢাকেশ্বরী মন্দিরে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দার জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর যাতে কোনো হামলা না হয়; সে জন্য সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানিয়েছেন।
এসময় পরিষদের সভাপতি জে এল ভৌমিক বলেন, কিছু মানুষ চায় না দেশে হিন্দুরা থাকুক। আওয়ামী লীগেও এমন ব্যক্তিদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে অভিযোগ তার। সাম্প্রদায়িক হামলার পূনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে সেই আহ্বান জানিয়ে স্বাধীনভাবে পূজা উদযাপনে সবার সহায়তাও চান জে এল ভৌমিক।
সম্প্রতি কাছাকাছি সময়ে কুমিল্লায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ মিছিলে বাধা দিয়েছে পুলিশ। একই সঙ্গে মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ধাওয়ায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মিছিলটি। কুমিল্লা নগরীর নজরুল অ্যাভিনিউ এলাকায় ওই ঘটনায় তিনজন আহত হন বলে জানিয়েছেন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা। পরে অবশ্য পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।
উল্লেখ্য, ‘মদমুক্ত দুর্গা পূজা’ নিয়ে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনের বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য উল্লেখ করে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ঐক্য পরিষদ।
সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে কখনো কখনো এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটছে কেনো? কারা ঘটাচ্ছে? এর বিরুদ্ধে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের সংগঠনগুলোর প্রতিবাদ করার শক্তি ও সামর্থ্য কতটুকু আছে? রাজনীতির পণ্য বানাতে তাদেরকে কব্জা করে রাখার একটি চর্চা বহুদিনের। আবার নিজেদের পছন্দের দলের হাতে নিগৃহিত হয়ে কাঁতরালে তৃপ্তি পাওয়ার মহলও আছে। পুরোটাই রাজনৈতিক ব্যাপার। কোনোটাই কাম্য নয়। ক’দিন আগে রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাশ গুপ্ত। ক্ষমতাসীনদের খাস পছন্দের রানা দাশ গুপ্ত সরকারকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘কী দেবেন-কী নেবেন এবার আগেই ফয়সালা করতে হবে।’ আরেক বক্তব্যে বলেছেন, ‘সরকার চাইলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, না চাইলে হয় না।’
এ ধরনের কথার পূর্বাপরেও ব্যাপক রাজনীতি। সচরাচর নির্বাচনের সময় সংখ্যালঘুদের নিয়ে রাজনীতির একটা ঝড় ওঠে বাংলাদেশ এবং ভারতে। এবার ধর্ম বিচারে লঘু-গুরুর কচলানি একটু বাড়বাড়ন্ত। এটি মোটেই শুভলক্ষণ নয়। যোগফলে শুধু রাজনীতি নয়, গোটা দেশ ও সমাজ ব্যবস্থার জন্য অশনি সংকেত। দেশে হিন্দু বনাম মুসলমানের লড়াই স্থল বানালে কেউই জয়ী হবে না। সাময়িক বা তাৎক্ষণিক সুবিধা নেবে কোনো না কোনো দল। দেশ কী পাবে? যে কোনো সংখ্যালঘুকে রাজনৈতিক পণ্য করলে বাংলাদেশ হেরে যাবে। হারতেই থাকবে। সব ধর্মেরও মর্যাদা নষ্ট হবে। মানবতাও পরাস্ত হবে।
নির্বাচন সামনে রেখে হিন্দুদের আয়ত্বে রাখার নতুন চেষ্টা বা এজেন্ডার পাশাপাশি কিছুদিন ধরে হিন্দু আইন নিয়ে নানা ফেরকা বাধানোর উদ্দেশ্যও প্রশ্নবিদ্ধ। পন্ডিতদের বানানো বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্রে বিভিন্ন রকম বিধান আছে। বিধানগুলো আদিকাল থেকে ভারতবর্ষের সমাজে সর্বত্র প্রয়োগ হয়েছিলো বলে পর্যাপ্ত প্রমাণ নেই। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে এসব বিধানের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের প্রথাও প্রচলিত ছিলো। সেইসব প্রথা, শাস্ত্রবাণী এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গোষ্ঠী বা গোষ্ঠীপতিদের পরামর্শ মিলিয়ে ইংরেজরা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকার মানুষের জন্য বিভিন্ন রকম হিন্দু আইন চালু করে গেছে। হিন্দু আইন বানিয়েছে ইংরেজরা; আবার শাস্ত্রীয় বিধানের নামে এহেন নিষ্ঠুরতা, অন্যায্যতা ও অমানবিকতার কিছু কিছু নিরসনও করে গেছে বৃটিশ সরকার। ইংরেজরা তাদের শাসনকালের শেষের দিকে কয়েকটি সংশোধনমূলক কোডিফাইড হিন্দু আইন বানিয়ে গেছে। হিন্দু আইনের সঙ্গে সনাতন ধর্মের বিশেষ সম্পর্ক নেই। ব্রিটিশ আমল থেকেই হিন্দু আইন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য বিভিন্ন রকম। বাংলা এবং আসাম ছাড়া গোটা ভারতে ইংরেজরা মিতাক্ষরা আইন প্রচলন করেছিলো। তার সঙ্গে বাংলায় প্রচলিত দায়ভাগ আইনের আকাশ পাতাল তফাৎ। নাম্বুদ্রি আইন, কঙ্কনা আইন, ময়ুখ আইন এবং নেপালের মুলুকি আইন স্বতন্ত্র। বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের বেশিরভাগই দু’শ বছরের ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে করা আইনের ফলোআপ বা আপডেট। নেপালের মুলুকি আইন ছাড়া অন্য কোথাও কোনো হিন্দু শাসকও হিন্দু আইন বানায়নি। আইন প্রণয়ন ও পরিবর্তনের কাজ সরকারের। সরকারকেই এটা করতে হবে।
দুঃখজনকভাবে কিছু মহলের তৎপরতায় অনেকটা স্পষ্ট কেবল রাজনৈতিক পণ্য বানিয়ে আয়ত্বে রাখার কুমতলবে সংখ্যালঘুদের নিয়ে কিছু তৎপরতা ওপেন সিক্রেটের মতো। এ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু নেতাদের সচেতনতা বিশেষভাবে কাম্য। সংখ্যালঘুরা মার খেলে আরো খাক, খেতে থাকুক, তারা তো ওদিকেরই লোক- এমনটি ভেবে যারা বিকৃত স্বস্তি পান, তাদেরও দায় আছে। কারো অসহায়ত্বে মুখ টিপে হাসা, তৃপ্তি অনুভব করা মানবতা নয়। কোনো ধর্মেই তা অনুমোদন করে না। ধর্মহীনদের কাছেও তা পছন্দের হবে না।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, বাংলাপোস্ট(সাপ্তাহিক)
মন্তব্য করুন: