সুফল পেতে নিশ্চিত করতে হবে শতভাগ ব্যবহার
কর্ণফুলি টানেল: ওয়ান সিটি টু টাউনে রূপ নেবে চট্টগ্রাম

দক্ষিন এশিয়ায় প্রথম চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলকে ঘিরে পুরো এলাকায় চাঞ্চল্য বিরাজ করছে । অনেকের ধারণা বন্দর নগরী চট্টগ্রামকে ওয়ান সিটি টু টাউনে রূপ দেবে এই টানেল। তাই এই টানেলকে ঘিরে চট্টগ্রামবাসীর মধ্যে তৈরী হয়েছে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। ২৮ অক্টোবর শনিবার টানেলটির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরদিন রোববার থেকে চলবে যানবাহন। ইতোমধ্যে নিম্নে ২০০ ও উর্ধ্বে ১০০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে যানবাহনের টোল। বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সম্প্রসারণ, আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে কর্ণফুলীর তলদেশে টানেল নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৬ সালে প্রকল্পটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শিজিন পিং। প্রকল্পটিতে ব্যায় হচ্ছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম এই ট্যানেল বাস্তবায়ন করেছে চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্মিত এই ট্যানেল আগামী ৫ বছর রক্ষণা-বেক্ষণের দায়িত্ব পালন করবে চীনা প্রতিষ্ঠান।
তবে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আবিষ্কৃত হচ্ছে নানা সমস্যা।টানেলের দুই প্রান্তের ইন্টারসেকশনগুলোর যানজটের বিষয়টি আগে চিন্তা করা হয়নি। এর সাথে রয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থাও। তাই সিডিএ এবং সিএমপি’র পরামর্শে যানজট এড়াতে নতুন করে নেয়া হয়েছে ৬৪৮ কোটি টাকার প্রকল্প।একইসাথে নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য নেয়া হয়েছে আরো সোয়া ৩০০ কোটি টাকার প্রকল্প। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আবিষ্কৃত এসব সমস্যা নিরসন ছাড়া ট্যানেলের শতভাগ ব্যবহার সম্ভব নয় বলছেন বিশেষজ্ঞরা।সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন সামস বলেছেন, ইন্টারসেকশনগুলোয় যানজটের আশংকা করছে সিডিএ ও সিএমপি। তাদের পরামর্শে ওয়ানওয়ে ট্রাফিক নিশ্চিত করার জন্য নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সিডিএ।যা চলমান রয়েছে।
আইইবি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদারসহ অনেক নগর পরিকল্পনাবিধ মনে করেন, ৪ লেনের এক ট্যানেলের অর্থ দিয়ে ২০ লেনের ৫টি সেতু করা যেত। তাই ক্ষতি পোষাতে ট্যানলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নবসৃষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধান ছাড়া এর শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা কষ্টসাধ্য হবে। বঙ্গবন্ধু টানেল দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে মনে করছেন তারা। তবে তা একপথে যোগাযোগের মাধ্যমে নয়। নদীর দুই পাশে সংযোগ আরো বাড়ানোর পরামর্শ তাদের।
এফবিসিসিআই সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেছেন, টানেল শুধু যোগাযোগ নয়,জিডিপিতে বিশেষ অবদান রাখবে এবং ব্যবসা-বানিজ্যের গেমচেঞ্জার হিসেবে কাজ করবে । যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পাশাপাশি নতুন করে শিল্পায়ন গতি পাবে। টানেলকে ঘিরে যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে সে সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।
যোগাযোগের জন্য যখন কোন এ্যাভিনিউ খোলা হয়, সেটা সব সময় কাজে লাগে। ডেপিনেটলি এটা উপকারে আসবে তবে এটি কতটুকু কস্ট এফেক্টিভ। অর্থাৎ কত টাকার বিনিময়ে কিনলাম। এটার বিকল্প ব্যবস্থা অনেকেই বলেছিলেন। একই খরচে কয়েকটি সেতু করার কথা। বঙ্গবন্ধু টানেল হচ্ছে টু লেন বাই টু লেন ফোর লেন। আর এটা দিয়ে অন্তত ফোর লেনের ৪/৫টা ব্রিজ করা যেত। তাহলে আমরা অন্তত ২০ লেনের উপকার পেতাম। তো যাই হোক একই মূল্য দিয়ে আমরা ৪ লেনের উপকার পাচ্ছি। উপকারতো পাবই।
তবে টানেলের ভেতর দিয়ে চলাচলে দূরত্ব কমে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। দৈর্ঘ্য কমে যাওয়া মানে সময় কমে যাওয়া। দৈর্ঘ কমে যাওয়া মানে যানবাহন চলাচলে ফুয়েল কম লাগা। সেই দিক থেকে আমার একটা বিনিফিট পাবো। তবে এই টানেলে সবসময় আলো ও অক্সিজেন নিশ্চিত করতে হবে।সাথে আছে বড় রক্ষণা বেক্ষণের বিষয় । এটি হাইলি মেকানাইজড। এ ব্যাপারে আমরা কতটুকু দক্ষ জানিনা । আমরা স্লুইচগেটও রক্ষা করতে পারিা্না । দেশের ৯০ শতাংশ স্লুইচগেট সব সময় কার্যকর থাকে না। সেই দিক থেকে একটা ভয়ভীতি থাকতে পারে টানেলটা আমরা কতটুকু রক্ষণা-বেক্ষণ করতে পারবো।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে টানেলটি এখানে অবস্থান করছে। টানেলটির সর্বোচ্চ ব্যবহার আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে তার টোলটাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।যদি সহনীয় পর্যায়ে না রাখা হয় তাহলে এই টানেলকে জনগণ এড়িয়ে যেতে চাইবে। দূরত্ব কমায় সাশ্রয়কৃত টাকা যদি টোল দিয়ে চলে যায় তাহলে ওই পথ মাড়াবে না । কারন বিকল্প পথ আছে আরো দুটি কালুর ঘাট সেতু ও কর্ণফুলী সেতু। তাই কস্ট ইফেকটিভ করতে হবে যাতে এই টানেল সবা্ই ব্যবহার করতে পারে।
টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে কক্সবাজার সড়ক হলো একটি। কালুরঘাট সেতু এক লেন, কর্ণফুলী সেতু ৪লেন এবং টানেল ৪লেন মিলিয়ে ৯লেন। এই ৯লেনের গাড়ি কক্সবাজার সড়কে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকলে যানজট হবে। টানেলে সাশ্রয় করা সময় যানজট খেয়ে ফেলবে কিনা তা চিন্তা করতে হবে। সবদিক মিলিয়ে সেইদিকেও যদি আমার ব্যবস্থা নেই । একইসাথে ঢাকা থেকে আসা সড়কে ৪ লেনের ব্যবস্থা আছে। ইন্টারসেকশনগুলোর সমস্যা নিরসন করতে না পারলে আমরা অচিরেই এর সুবিধা পাবো না।
যেহেতু টাকা বিনিয়োগ হয়ে গেছে সুদের কিস্তি শুরু হয়ে যাবে। সেহেতু বিনিয়োগ থেকে সুদাসল উঠে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। এখন টানেল যৌক্তিক কি অযৌক্তিক এই প্রশ্ন করে লাভ নেই, টানেল হলো বাস্তবতা। সে কারনে যত দ্রুততার সাথে সম্ভব তার শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। তবে সংযোগ সড়কগুলো যে গতিতে হওয়ার কথা সেই গতিতে হচ্ছে না। আনোয়ার পিএবি সড়ক চকরিয়া পর্যন্ত কোথাও ১ লেন কোথাও ২লেন। এটি সম্প্রসারণ করা দরকার।চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়কের সাথে সংযোগ বাড়াতে হবে। দ্রুততার সাথে করতে না পারলে আমরা শতভাগ ফল ভোগ করতে পারবো না। শতভাগ ফল ভোগ করতেই হবে আমাদেরকে। না হয় অর্থ যা খরচ হয়েছে তা অর্থনীতিতে চাপ তৈরী করবে। আমরা চাই না আমাদের বৃহদাকার প্রকল্পগুলো অর্থনীতির উপর চাপ তৈরী করুক।
নাসির উদ্দিন, চট্টগ্রাম ব্যুরো প্রধান, বাংলাভিশন
মন্তব্য করুন: