রাজনীতি যার যার অর্থনীতি সবার
টানা কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর আবার ফিরে এলো সেই হরতাল-অবরোধ। রাজনীতির এ অস্ত্রটি অর্থনীতির জন্য সর্বনাশা। এমনিতেই অর্থনীতির দশা করুণ। নিত্যপণ্যের বাজারে পাগলা ঘোড়া ছুটছে দানবের মতো। গোল আলু থেকে শুরু করে পেঁয়াজ-মরিচ-শুটকি সবখানেই সিন্ডিকেট। রপ্তানি আয় কমছে। আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে সকল মাত্রা ছাড়িয়ে। তৈরি পোশাক শিল্প সেক্টরেও বিপর্যয়। প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স খাতে অবিরাম খরা। কোনো সূচকেই সুসংবাদ নেই। দেশে বর্তমানে যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে, তার ভুক্তভোগী সাধারন মানুষ। এর মাঝে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশের চার কোটির বেশী মানুষ ইউরোপের ষ্টান্ডার্ডে বাস করে। তার কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য থাকতেও পারে। তা মেনে নিলেও- অবশিষ্ট ৮০% মানুষ দরিদ্র। তাদের জীবন দুর্বিষহ। সামর্থবানরা টাকা সরিয়ে ডলার কিনে রাখছে। অর্থ পাচার করছে। বিপর্যস্ত শেয়ার বাজারে মানুষের লক্ষ কোটি টাকা আটকে আছে। যে যেখান দিয়ে যেভাবে পারে লুটপাট করছে। এসবের পরিনতিতে সব জিনিসপত্রের দাম এখন লাগামছাড়া। এভাবে চলতে পারে না। এরপরও চলছে।
সরকার মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে ডলারের দাম বাজারের উপর ছেড়ে দেয়া হবে। তাতে নাকি হুন্ডির বদলে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসবে। ফলে ডলার ক্রাইসিস দূর হবে। বাস্তবটা ভিন্ন। পাকিস্থান এই পথে হাটতে গিয়ে আরো বাজে পরিণতিতে পড়েছে। দেশটির সরকার ডলারের মাধমে অর্থপাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়ায় ডলারের দাম অনেকটা কমে এসেছে। রেমিট্যান্সে হুন্ডির প্রভাব ততদিন কমবে না, যতদিন এদেশ থেকে ডলারের মাধ্যমে অর্থ পাচার বন্ধ না করা যাবে। আলামত বলছে, ডলারের দাম বৃদ্ধির কারনে নিত্যপণ্যের দাম আরো বাড়বে। কারন, আমাদের অর্থনীতি মুলত: আমদানিনির্ভর। ভোগ্যপণ্য, জ্বালানী তেল সবকিছুই কিনে আনতে হয়।
রাজনীতির নানা বিষয়ে পথেঘাটে কচলানি বা প্যাচাল থাকলেও রাজনীতি এখন মানুষের জন্য বিরক্তি আইটেম। সাধারন মানুষ এর থেকে পরিত্রান চাইছে। দ্রব্যমুল্যবৃদ্ধি আর সেইসাথে আয় কমে যাওয়ায় মানুষ দিশেহারা। ডলারের সংকটে ব্যাংকগুলো এলসি খুলতে পারছে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। আগামীতে এই সংকট আরো বাড়বে। তারওপর মানুষের নৈতিকতায়ও বেদম অবনতি। ধনী- দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই এখন অর্থের পিছনে ছুটছে। এতে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। দরিদ্ররা রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যবস্থা সম্মন্ধে অজ্ঞ থাকায় এই দৌড়ে জিততে না পেরে আরো দরিদ্র হচ্ছে। এর মাঝেও আমাদের যে পরিমান জাতীয় আয়, তা যদি দক্ষ ব্যবস্থাপনায় ব্যয় করা গেলে বাইরের কারো কাছে হাত পাতা লাগে না। চুরি-দুর্নীতি, লুটপাট-পাচার রোধে ব্যবস্থা নিলেও এ অবস্থার খরা অনেক কেটে যেতেও। কিন্তু, ক্ষমতাসীন বা বিরোধীদল কারো মধ্যেই এ বিষয়ে কোনো এজেন্ডা নেই। জাতীয় ঐক্যমত্য ছাড়া এ এজেন্ডা নেয়া তাদের পক্ষে সম্ভবও নয় । একক কোন দলের পক্ষে তা সম্ভব না। কারন, বিপরীত দিকে দুর্নীতিবাজ আর লুটেরারা অনেক বেশী শক্তিশালী।
আমাদের অর্থনীতির ধমনিতে রক্ত সঞ্চালনের আরেকটি জায়গা পূঁজি বাজার। সেখানকার "ফ্লোর প্রাইস" এখন বিরোধী দলের উপর! কোমড়ে দড়ি! হাতে পায়ে ডাণ্ডা বেড়ি! অন্যভাবে বললে শেয়ার বাজারে জনগণ ও বিনিয়োগকারী একই অবস্থানে। বর্তমান ব্যবস্থাপনায় সূচকের ধনাত্মক বা ঋণাত্মক পরিবর্তন বার্তাবহ নয়। নেতিবাচক সূচকগুলো ঊর্ধগামী। শেয়ার বাজার কেন এভাবে ফুটপাতের দোকানদারিও চলে না। শোনা যায়, শেয়ারবাজারে সব মিলিয়ে কম বেশী ৩০ হাজার কোটি টাকা ফ্লোর প্রাইস সিন্দুকে 'জব্দ' অবস্থায় পড়ে আছে। তাতে বাজারে তারল্য খরা তীব্রতর হয়েছে। লেনদেন টিকিয়ে রাখা হয়েছে শুধু বীমাখাতের কোম্পানিগুলোসহ ছোট ও মাঝরি আকারের পরিশোধিত মূল ধন কোম্পানির সিকিউরিটিজের মাধ্যমে।
এ ব্যবস্থায়, অস্তিত্বহীন, উৎপাদন বন্ধ ও দুর্বল মৌল শক্তির কোম্পানির সিকিউরিটিজ যুক্ত আছে। অস্তিত্বহীন কয়েকাটি কোম্পানির সিকিউরিটিজ আবার এ বাজারের মহাজন। সার্বিক বাজার ব্যবস্থাপনা কারসাজি ও দুর্নীতি বান্ধব হওয়ায় বাজার চিত্রের বিভৎস রূপ আরও প্রকট হয়েছে। তারওপর দেশের রাজনীতি ক্রমাগত বিপর্যয়ের দিকে ধাবমান। চলমান রাজনীতির সমাধান অহিংস পথে হবে না সংঘাতের মাধ্যমে ফয়সালা হবে তার ওপর নির্ভর করবে দেশের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ। উভয় দলের মধ্যেই যুদ্ধংদেহী মনোভাব। চলমান রাজনীতির সমাধান অহিংস পথে না হলে দেশের অর্থনীতি আরো অন্ধকারে ডুববে। মূল্যস্ফীতির চাপ নির্দিষ্ট বা বাঁধা আয়ের মানুষের ওপর আরও কত দুর্বিষহ হয়ে উঠবে তা নিশ্চিত।
ঘোষণা ছিল ‘খেলা’ নিয়ে। সেটা অবশ্যই রাজনৈতিক ‘খেলা’। কূটনীতিও থাকতে পারে। ‘খেলা হবে-খেলা হবে’ করতে করতে খেলাটা চলে গেছে বাজারে। এ বাজারি খেলায় ধুলা উড়াচ্ছে কথিত সিন্ডিকেট। আজ ডিম, কাল লবন-মরিচ। পেঁয়াজ-আদা-, চাল-ডাল-তেল। কিছুতেই ছাড় নেই। তাদের উড়ানো ধুলায় চোখে অন্ধকার, মুখে বোবা কান্না নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের। ধনাঢ্যদের কথা আলাদা। এ নারকীয়তায়ও স্বর্গের বাংলাদেশ ব্রাঞ্চে অবগাহনকারীরা আরো আলাদা। যেন ভিন গ্রহের। চালের কেজি পাঁচ’শ, পেঁয়াজ হাজার বা কাঁচা মরিচের কেজি দু’হাজার টাকা হলেও কোনো ঝাঁঝে পাবে না তাদের। এ চক্র আচ্ছা খেলোয়াড়। এ খেলার মধ্যে ধুলা উড়ানো অতি খেলোয়াড়রা সমানে পেনাল্টিতে মারছে মানুষকে। ঘায়েল করছে সরকারকেও। চাল, ডাল, তেল, নুন, চিনি, আটা, ময়দা, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, চামড়া, আমড়া সব কিছু নিয়েই খেলছে সমানে। ফ্রিস্টাইলে ধুলা উড়াচ্ছে। ডিমের বাজারেও দফায়-দফায় তাদের হাটটিমা-টিম গেইমের শিকার মানুষ বোবা দর্শক হয়েই থাকতে হচ্ছে।
দুহাতে অর্থ হাতানোর এ পদ্ধতিতে চাহিদা, জোগানের পরিমাণ; কে সরবরাহকারী-বিপণনকারী, কে ভোক্তা; এসবের কোনো বালাই নেই। শিকার ধরাই আসল। বাজার নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেটের কাছে বাদবাকিরা কেবলই শিকারের বস্তু। বাজার চড়ানোর পেছনে শীত-গরম, বৃষ্টি-খরা, মন্দা-য়ুদ্ধসহ হরেক অজুহাত তারা হাতে হাতেই রাখে। বাজারে চাহিদার বিপরীতে জোগান কমে যাচ্ছে নাকি কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে-তাও বিবেচনার বিষয়। ব্যবসায়ী নেতারাই বলছেন, সব পণ্য দ্রব্যই মজুত আছে, নাটক চলছে কৃত্রিম সংকটের। মানুষের খাদ্যপণ্য চাল, আটা, ডাল, চিনি, তেল, লবণ, সবজি, পেঁয়াজ, মরিচ, মাছ, ডিম, মুরগি কোনটার দাম না বেড়েছে বেড়েছে? সব কিছুর দাম ১০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এটি সিন্ডিকেটের দারুণ সমন্বয় ও সুযোগ। মলম পার্টির মতো জোরজবরদস্তি লাগছে না। মানুষকে আপোসেই নিজের চোখে নিজে মলম মেখে বোবা কান্না কাঁদতে হচ্ছে। একবার পেঁয়াজ, আর একবার মরিচ, কখনো ডিম তো কখনো মুরগি! এক মাসে তেলে আর ডালে চক্রাকারে চক্রশুলে চড়ছে।
কোনো রাজ্যে অনিয়ম-নৈরাজ্য নিয়মের মধ্যে পড়ে গেলে সেখানে আগুন- পানিও আর নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না। শয়তান তথা দুষ্টুরাও দমে না। এটি একদম অংকের মতো। অবস্থা এমন হয়ে গেলে হাঁস মুরগি পাহারায় শিয়ালকে নিযুক্ত করলে যা হয়, চিতা-কোবরাকে পাহারাদার নিযুক্ত করলেও একই ফল হয়। এদের কাছে দেবালয় আর লোকালয় বাছবিচার থাকে না। কেউ ক্ষমতায় আছেন, আরো থাকবেন বলে ছক আঁকছেন। কেউ ক্ষমতায় আসবেন পাকাপোক্ত হয়ে। সেই প্রস্তুতিতে কোমর বাঁধছেন। তাদের উভয়ের মন-মনন, মানসিকতা, কথা-কাজ বোঝার কারো বাকি নেই। আমাদের সমাজের ধরিবাজরা আগোয়ান হন সেই আলোকেই। যার মধ্য দিয়ে তারা হয়ে ওঠেন শেয়ানের ওপর শেয়ান, চতুর।
লেখকঃ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : বাংলাপোষ্ট
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
মন্তব্য করুন: