• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ২০ জানুয়ারি ২০২৫

সামনে শ্রীলঙ্কা না তিউনিসিয়া?

মোস্তফা কামাল

প্রকাশিত: ১৪:৪২, ৩ জানুয়ারি ২০২৫

আপডেট: ১৭:৩১, ৩ জানুয়ারি ২০২৫

ফন্ট সাইজ
সামনে শ্রীলঙ্কা না তিউনিসিয়া?

ফাইল ছবি

আগস্ট আন্দোলনের ছাত্রদের রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিকতা বাড়ছে। সুনাম জিন্দাবাদের সাথে কিছু দুর্নামও যোগ হচ্ছে। দেশকে সাংবিধানিক ধারার বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার অভিযোগও এখন তাদের ঘাড়ে। জুলাই বিপ্লবের প্রক্লামেশন দিতে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ওটাকে একবার বলা হয়েছে বেসরকারি উদ্যোগ। পরে সরকারই এ ঘোষণার দায়িত্ব নিয়েছে। এর আগে, রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবি তুলে শিক্ষার্থীদের পিছু হটতে হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী জাতীয় পার্টিকে নিষিদ্ধ চেয়েও সুবিধা করতে পারেনি। তারওপর কিংস পার্টি গঠনের তৎপরতার অভিযোগে সেই সার্বজনীনতা হারিয়েছে। 

আন্দোলন ও সরকার বিতাড়ন প্রশ্নে শ্রীলঙ্কা-তিউনিসিয়া-বাংলাদেশ বেশ প্রাসঙ্গিক। তিনটি অভ্যুত্থানের মধ্যেই বেশ মিল। পতিত এ তিন সরকারই ছিল চরম ফ্যাসিস্ট । নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দল নয়, তরুণদের দ্রোহে সামিল হয়ে সাধারণ মানুষ রাস্তায় আসে। শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে ঘটা অভ্যুত্থানের দুই বছরের মধ্যেই শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। অথচ, তিউনিশিয়ায় অভ্যুত্থানের সময় পেরিয়েছে এক যুগেরও বেশি। এখনো অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ের অস্থিরতা থেকে বের হতে পারেনি দেশটি। 

বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পাঁচ মাসেও জনজীবনে স্বস্তিদায়ক পরিবর্তন আসেনি। উন্নতি হয়নি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও। অথর্নৈতিক অবস্থা পুনুরুদ্ধারের চেষ্টায় সাফল্যের লক্ষণ নেই। গোতাবায়া রাজাপাকসে সরকারের পতনের সময় শ্রীলংকায় মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ৬৭ শতাংশ। ডলার সংকটে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করা দক্ষিণ এশিয়ার দ্বীপদেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও তখন ৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে।  দুই বছরের মধ্যেই তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে সফলতার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানোর নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা। মূল্যস্ফীতি নয়, বরং চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত টানা তিন মাস মূল্য সংকোচনের দেখা পেয়েছে দেশটি। রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৬ বিলিয়ন ডলারে। অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবেও শ্রীলঙ্কা এখন বেশ স্থিতিশীল। দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচনে আনুরা কুমারা দিশানায়েকের বামপন্থী জোট ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার-এনপিপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সব রাজনৈতিক দলকে দেশ গড়ার কাজে যুক্ত করতে পেরেছে। গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া তরুণ প্রজন্মও নিজ নিজ কাজে ফিরে গেছে। 

বিপুল গণবিক্ষোভের মুখে ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিউনিসিয়ার স্বৈরশাসক জাইন এল আবিদিন বেন আলির পতন ঘটে। ২৩ বছর ধরে ক্ষমতা আটকে রাখা এ শাসক দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এ আন্দোলন পরিচিতি পেয়েছিল জেসমিন রেভল্যুশন বা জেসমিন বিপ্লব নামে। আরব বসন্তের সূচনাকারী সফল এ অভ্যুত্থানের এক দশকের বেশি সময় পেরোলেও তিউনিশিয়া এখনো দিশা খুঁজে পায়নি। অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনীতিতেও স্থিতিশীলতা ফেরেনি। অর্থনৈতিক সংকোচন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ খরা, বেকারত্ব, দুর্বল রিজার্ভসহ নানামুখী চাপের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে তিউনিশিয়া। বেন আলির পতনের পর এখন পর্যন্ত দেশটির শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন এসেছে চারবার। কোনো সরকারই জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। বেগতিক পরিস্থিতিতে জেসমিন বিপ্লবে নেতৃত্ব দেয়া তিউনিসিয়ান তরুণদের কিছু সংখ্যক নিগৃহিত হয়ছেন। অনেকে দেশ ছেড়েছেন। বাংলাদেশের শ্রীলংকার মতো ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষণ নেই। ছাত্ররা ঘরে ফিরে যাচ্ছে না। আবার তিউনিসিয়ার মতো না হলেও নমুনা ভালো হয়। রাজনৈতিক বোঝাপড়ার লক্ষণ নেই। টানা ১৫-১৬ বছর ক্ষমতায় থেকে যারা নানা দুষ্কর্ম করেছে তাদের কোন অনুশোচনাও নেই। 

এর সমান্তরালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনও এখন আর সার্বজনীন কোন প্লাটফর্ম নয়। মাস কয়েক আগেও সহযোগিতা দেয়া রাজনৈতিক দলগুলো তাদেরকে আগের মতো আমল দেয় না। প্রতিপক্ষও ভাবে। সংবিধানে তত্বাবধায়ক ব্যবস্থায় নির্বাচন ফিরে আসার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী সংস্কারের প্রধান কাজটি হয়ে গেলেও ছাত্রদের কারণে সরকার ঢিলেমি করছে বলে তাদের মুরুব্বি দল বিএনপি।  আরো কিছু দলও মনে করে নির্বাচন বিলম্বিত করার উদ্দেশ্য কোনো দলকে মাঠ গোছানোর সুযোগ করে দেয়া, কাউকে দল গঠনের সুযোগ করে দেয়া। তাদের কারণে সরকারও সমালোচনার পাত্র হয়ে গেছে। ভারত ইস্যুতে সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকের আগে কেবল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্র নেতাদের সাথে বৈঠককে রাজনীতিকরা ভালোভাবে  নেননি। পাত্তা কম বলে অনুভব করছেন তারা। 

তারুণ্যের উম্মাদনা বলে সব কিছু মেনে নিতে চান না সিনিয়র নেতারা। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া শতকরা ৯৫ জন বাঙালি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পড়েইনি। তারা জীবন থেকেই জেনেছিল  পাকবাহিনী এবং তাদের দোসরদের পরাজিত না করতে পারলে নিজেদের বেঁচে থাকার কোনো সুযোগ নেই। চব্বিশে মানুষ রাস্তায় নেমেছিল দেশের বুকে জগদ্দল পাথরের মতো বসে থাকা হাসিনা-শাসনকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে। এর কোনো বিকল্প ছিল না তাদের সামনে। শেখ হাসিনা না থাকলে বাংলাদেশই থাকবে না, কয়েক লাখ লোককে মেরে ফেলা হবে- এ ধরনের মারফতি কথা বাজারে চালানো যায়নি। মানুষের কথা ছিল, আগে হাসিনা যাক, তারপরে যা হয় দেখা যাবে। তাদের অন্তত ৮০ ভাগ মানুষ শহীদ মিনারের ঘোষণাপত্র শোনেনি। এখনও শুনতে চায় কিনা, সেটাও প্রশ্ন। ক্ষমতায় যেই থাক তারা স্বস্তি চায়। কিন্তু, সেখানে অস্বস্তি যোগ হতে থাকা ছাত্রদের জন্যও মন্দ খবর। প্রয়োজনে আবার রাস্তায় নামা, আবু সাঈদ, মগ্ধের মতো জীবন দেয়া- এগুলোও ভালো কথা নয়। 

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন 

বিভি/এআই

মন্তব্য করুন: