স্মরণ
সাহাবুদ্দীন আহমদ : অন্যতম সেরা রাষ্ট্রপতি-বিচারপতি

সাহাবুদ্দীন আহমদের সঙ্গে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া
দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে সব রাজনৈতিক দলের বিরল ঐকমত্যে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সে সময়ে রাষ্ট্রপতি পদ এখনকার মতো আলংকারিক নয়; সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল। কিন্তু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে প্রয়োজনের বেশি এক দিনও থাকতে রাজি ছিলেন না। এ কারণে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকা সেই রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ আর নেই। দীর্ঘদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে ৯২ বছর বয়সে গত ১৯ ই মার্চ শনিবার ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)।
১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি ষষ্ঠ প্রধান বিচারপতি হিসেবে সাহাবুদ্দীন আহমদকে নিয়োগ দেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ওই বছরের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বাম দলগুলোর নেতৃত্বাধীন তিন জোটের আন্দোলনে এরশাদের পতন হয়। প্রশ্ন দেখা দেয়- কে হবেন রাষ্ট্রপতি। কার অধীনে হবে পরের নির্বাচন? তিন জোট সাহাবুদ্দীনকে রাষ্ট্রপ্রধান করতে একমত হলেও তিনি বিচারালয় ছাড়তে রাজি ছিলেন না। নির্বাচন শেষে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে যাবেন- এই শর্তে রাষ্ট্রপতি হন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করে মিনিট দশেক পর তার কাছে পদত্যাগপত্র দেন এরশাদ। এর মাধ্যমে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। ওনার অস্থায়ী সরকার তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে পরিচিত পায়। তৎকালিন রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মনজুর রশীদ খানের 'এরশাদের পতন ও সাহাবুদ্দীনের অস্থায়ী শাসন' বইয়ে সে সময়ের বর্ণনা ও বিশ্নেষণ উঠে এসেছে। মনজুর রশীদ লিখেছেন- অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। ফলে ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসেরও কম সময়ে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচন ছিল দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সুষ্ঠু।
নির্বাচনে জয়ী বিএনপি সরকার গড়লেও তখনও রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা ছিল। মনজুর রশীদ লিখেছেন, ক্ষমতা থাকার পরও প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কাজে হস্তক্ষেপ করেননি সাহাবুদ্দীন আহমদ; বরং দ্রুত সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তাগিদ দিয়ে গেছেন। খালেদা জিয়া মন্ত্রিসভাশাসিত সরকার পদ্ধতির চেয়ে রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীতে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তিত হয়। সংশোধনীতে সই করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ নিজের ক্ষমতা কমানোর বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
সরকার ও বিরোধী দলের বিরল সমঝোতায় সংবিধানের একাদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর ৩০৮ দিন দায়িত্ব পালন শেষে রাষ্ট্রপতির পদ ছেড়ে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফিরে যান সাহাবুদ্দীন আহমদ।
১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় ফিরে রাষ্ট্রপতি পদে তাকে প্রার্থী করে আওয়ামী লীগ। তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় দফায় তিনি আলংকারিক রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পাঁচ বছর ৩৬ দিন দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গভবনে থেকেও নিজ খরচে ব্যয় নির্বাহ করে সততার দৃষ্টান্ত হিসেবে এত বছর পরও স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তিনি।
২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর বঙ্গভবন থেকে বিদায়ের পর গুলশানের বাড়িতে নিভৃত জীবনযাপন করছিলেন সাহাবুদ্দীন আহমদ। সাহাবুদ্দীন আহমদের বড় মেয়ে ২০০৫ সালে মারা গেছেন। বাকি সন্তানদের মধ্যে দুই মেয়ে বিদেশে রয়েছেন। দুই ছেলে বাবার মৃত্যুর সময় পাশে ছিলেন।
সাবেক প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ছিলেন বিচার অঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র। বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় স্বর্ণযুগের যে ক’জন বিচারপতি ছিলেন তার মধ্যে সাহাবুদ্দীন আহমদ অন্যতম। তার অষ্টম সংশোধনীসহ অনেক ঐতিহাসিক রায় রয়েছে। এখন থেকে ১০০ বছর পরও পুরো জাতি বিশেষ করে বিচার অঙ্গনের সবাই তাকে মনে রাখবেন।
জানাজা পূর্ব বক্তব্যে সাহাবুদ্দীন আহমদের ছোট ছেলে সোহেল আহমদ বলেন, তার বাবা কর্মজীবনের অধিকাংশ সময়ই এই বিল্ডিংয়ে কাটিয়েছেন। ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবন উভয় মিলে তিনি মনে প্রাণেই একজন বিচারক ছিলেন।
১৯৩০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সাহাবুদ্দীন আহমদ নেত্রকোনার কেন্দুয়ার পেমই গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দু’বার দেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্বপালন করেন। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এরশাদের পদত্যাগের পর তিনি প্রথমে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ।
১৯৯৬ সালের ২৩ জুলাই থেকে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত তিনি দ্বিতীয় দফা রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি ১৯৯০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৯৫ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি ছিলেন। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি হাইকোর্টের বেঞ্চে তাকে বিচারক হিসেবে উন্নীত করা হয়। ১৯৭৩-৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার পর তাকে হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে ফিরিয়ে আনা হয়। ১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাকে আপিল বিভাগের বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী সম্পর্কিত মামলায় তার দেয়া রায় যুগান্তকারী।
দেশের ক্রান্তিলগ্নে গণতন্ত্র উত্তরণে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। স্বৈরতন্ত্র থেকে দেশকে গণতন্ত্রে ফিরিয়ে আনতে তিনি নিজের ভূমিকাটা সেদিন সঠিকভাবে পালন করেছিলেন। সেসময় বিভিন্নভাবে চাপ সত্বেও তিনি নৈতিক অবস্থান, সাংবিধানিক অবস্থানে অনড় ছিলেন।
স্বৈরশাসক থেকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের ভূমিকা জাতি চিরকাল স্মরণ রাখবে। তিনি সততা ও দৃঢ় অবস্থান থেকে দেশকে অনেক কিছু দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনকালীন সময়ে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ধারণাটা, এটা যে সঠিকভাবে পালন করা যায়, সেটাও তিনি প্রমাণ করেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারে যদি সঠিক লোকের সঠিক নেতৃত্ব থাকে এবং সঠিকভাবে পালন করা হয়, তাহলে বাংলাদেশের মানুষের ভোটাধিকার বঞ্চিত হওয়ার যে প্রবণতা চলছে, সেখান থেকে উত্তরণ সম্ভব। এটা তিনি প্রথমেই প্রমাণ করেছেন। পরবর্তীকালে তার মতো করে কয়েকটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেটা সঠিকভাবে পালন করেছে। সেটাকেই নিরপেক্ষ নির্বাচনের একটা রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সদিচ্ছা থাকলে কাজ করা যায়, সেটা সম্ভব করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ।
মন্তব্য করুন: