পাকিস্তানে সেই পুরনো শকুনের থাবা!

ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর একজন বাঙালী জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার জন্ম এবং মৃত্যু একই দিন ১৩ নভেম্বর, কারো কারো মতে তারিখটি নাকি অপয়া। ১৯৪৬খ্রিঃ তিনি ব্রিটিশ ভারতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ে যুগ্ম সচিব ছিলেন। ১৯৪৭খ্রিঃ প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খাঁন তাকে সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানের ডিফেন্স সেক্রেটারি নিযুক্ত করেন।
বগুড়ার মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী হলে ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব পাকিস্হানের ভাষা আন্দোলন দমণ করতে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্ণর নিযুক্ত করে পাঠানো হলো। ২৯ মে ১৯৫৪খ্রিঃ তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক সরকার বিলুপ্ত করলেন এবং ১ জুন মূখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সামরিক শাসন জারি করেন পূর্ব-পাকিস্তানে। সেদিন তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে নেমেই মওলানা ভাষানীকে গুলি করে হত্যার হুমকি দেন। এবং প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং ইউসুফ আলি চৌধুরীসহ প্রায় ৫০০ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করেন যা ১৫ দিনেই ৩৩জন সংসদ সদস্য ও দুইজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ হাজার ছাড়িয়ে যায়।
ইস্কান্দার মির্জা বরাবরই পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলামের বিশ্বাসভাজন ছিলেন। ১৯৫৫খ্রিঃ মালিক গোলাম ব্রেণ স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হোয়ে চলাচল ও বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তিনি তার প্রিয়ভাজন ইস্কান্দার মির্জাকে এ্যাক্টিং গভর্ণর জেনারেলের দ্বায়িত্ব দিয়ে চিকিৎসার জন্যে দুইমাসের ছুটি নিয়ে লন্ডনে যান। ৭ আগষ্ট ১৯৫৫খ্রিঃ ইস্কান্দার মির্জা লন্ডনে চিকিৎসাধীন অসুস্হ গভর্নর জেনারেল মালিক গোলামকে বরখাস্ত করেন এবং বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়ে দেন। ২৩ মার্চ ১৯৫৬ খ্রিঃ থেকে ২৭ অক্টোবর ১৯৫৮খ্রিঃ তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট থাকতে পেরেছিলেন। এই আড়াই বছরে তিনি চারজন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেন। এরা হোলেন বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দ্দী, আই আই চুন্দ্রিগড় ও ফিরোজ খানঁ নুন।
২৬-২৭ অক্টোবর ১৯৫৮ মধ্যরাতে লন্ডনগামী একটি প্লেনে ইস্কান্দার মির্জাকে যখন তুলে দিয়েছিলো সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ুব খাঁন। তখনকার এ্যাডমিরাল এ আর খাঁন এবং চার জেনারেল আজম, আমির, ওয়াজিদ এবং আসগার খাঁন কাঠের পুতুলের মতো দাড়িয়ে থাকলেন, দেখেও না দেখার ভাঁন করলেন। সে রাতেই মির্জা সাহেব জেনারেল আইয়ুব খাঁনকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযক্ত করে শপথ বাক্য পাঠ করান তারপরেও শেষ রক্ষা করতে পারেন নাই তিনি। শেষ পর্যন্ত লন্ডনে ছোট্ট একটি খাবার হোটেল চালিয়ে এই প্রেসিডেন্ট তার বাকি জীবন লন্ডনেই অতিবাহিত করেন।
১৯৬৯ এ পূর্ব-পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর ডাকে গণঅভূত্থানে যখন টালমাটাল অবস্হা, ১৩ নভেম্বর লন্ডনে মারা গেলেন এই বাঙালি জেনারেল পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট, পূর্ব-পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর ও প্রথম সামরিক শাসক নবাব মীরজাফর আলী খানেঁর বংশধর (প্রেতাত্মা) ইস্কান্দার মির্জা, তাও প্রায় বিনা চিকিৎসায়। এ সময় পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খাঁন পূর্ব-পাকিস্তানে তাকে দাফনের অনুমোতি দিলেন না। ইরানের রেজা শাহ পাহলভী ইস্কান্দারের মরদেহ ইরানে এনে সৎকার করেন। ইস্কান্দার মির্জার প্রথম স্ত্রী ছিলেন একজন ইরানী।
ইস্কান্দার মির্জার একমাত্র জীবিত ছেলে হুমায়ুন মির্জা তিনিও ৯৩ বছর বয়সে মারা গেলেন ওয়াশিংটনে এই জুন মাসে। সে তারিখটাও আনলাকি ১৩। তার বিখ্যাত বই পলাশী থেকে পাকিস্তান। তার দ্বিতীয় স্ত্রী নাহিদ আমিরতিমির কালানী তিনিও একজন ইরানী এবং নুসরাত ভুট্টোর ঘনিষ্ট বান্ধবী ছিলেন।
এই সম্পর্কটি জুলফিকার আলী ভূট্টোকেও পাকিস্তানী রাজনীতির কেন্দ্রে একটি পাকাপোক্ত আসন করে দেয় যদিও তার শেষ পরিনতি ছিলো একই ধারাবাহিকতা। জন্মলগ্ন থেকেই পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার টিকতেই পারে না, এবারে কি ইমরান খাঁনের পালা?
মন্তব্য করুন: