শহরেও আসে পরিযায়ী পাখিরা
পরিযায়ী পাখি বা পরিযানকরী পাখি, যারা একস্থান থেকে অন্যস্থানে, একদেশ থেকে অন্য দেশে এমন কি এক মহাদেশ থেকে অন্যমহাদেশে কাল ঋতু ভেদে পরিযান করে। সাধারণত খাদ্য, অনুকূল বাসস্থান, প্রজনন ইত্যাদি প্রয়োজনে হয়ে থাকে এই পরিযান।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ওরিয়েন্টাল নামক প্রাণী ভৌগলিক অঞ্চলে, গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা-মেঘনা অববাহিকায় অবস্থিত ছোট একটি দেশ বাংলাদেশের। ইন্দোচায়না এবং ইন্দোবার্মা জীব বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ অঞ্চলে অবস্থানের কারণে রয়েছে বন্যপ্রাণীর এক সমৃদ্ধ ভান্ডার, যার মধ্যে রয়েছে ৬৯০ এর অধিক প্রজাতির পাখি।
এই পাখিদের মধ্যে ৩৩৭ প্রজাতি আমাদের দেশের আবাসিক পাখি, ২০৮ প্রজাতি শীতকালীন পরিযায়ী, ১২ প্রজাতি গ্রীষ্ম পরিযায়ী, ১৪ প্রজাতি পান্থ পরিযায়ী এবং ১১৯ প্রজাতি ভবঘুরে হিসাবে বিবেচিত।
এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের মোট পাখির একটি বড় অংশ পরিযায়ী। আর এই পাখিদের আগমন ঘটে সারাদেশে এমনকি শহরেও আগমন ঘটে এই পাখিদের।
প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রফেসর ড মোহাম্মদ ফিরোজ জামান এর তত্ত্বাবধানে এবং মো. মাহাবুব আলম এবং ফজলে রাব্বী এর সহ তত্ত্বাবধানে বিগত ৫ বছর ধরে সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে শহরের পাখি এবং জলচর পাখিদের নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার। ঢাকাসহ বড় বড় শহর, যেমন ময়মনসিংহ, বরিশাল,রাজশাহী, ফরিদপুর, জামালপুর, ছোট শহর: মাগুরা, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিল পাখিদের পিছনে৷ গবেষণা থেকে দেখা যায়, ঢাকা শহরেই আসে ৪০ প্রজাতির অধিক অতিথি পাখি, যার মধ্য, মাছমুরাল, বিভিন্ন প্রজাতির খন্জন, জিরিয়া, বাটান, চ্যাগা, ছোট কান পেঁচা, আঁশটে দামা, ব্লু থ্রোট, রুবিথ্রোট, লাল গির্দি, সহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুটকি ও চুটকি জাতীয় পাখিরা। কিন্তু এদের সংখ্যা প্রতিবছর ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
এছাড়া ফরিদপুর এবং ময়মনসিংহ শহরে ৫০ এর অধিক প্রজাতি, মাগুরা শহরে ৩৪ প্রজাতি, জামালপুর শহরে প্রায় ৪৫ প্রজাতির পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটে। পুরো বাংলাদেশের কথা বিবেচনা করলে সংখ্যাটি অনেক বড়। এই পাখিদের মধ্যে ৩ প্রজাতির গ্রীষ্ম পরিযায়ী, যাদের সারাদেশেই দেখা যায়, যেমন; বউ কথা কও, চাতক পাখি, নীল লেজ সুইচোরা পাখি।
আর বাকি পাখিদের অধিকাংশ হলো শীতকালীন পরিযায়ী।
শহরের আবাসিক এলাকার বাগান, ঝোপঝাড়, তৃণভূমি, বাদা বন, জলাশয়ে আগমন ঘটে এই পরিযায়ী পাখিদের। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করে চলে যায় অন্যদেশে।
কিন্তু শহরে আজকাল আর আগের মতো সেই পরিবেশ টিকে নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন, আবাসস্থল ধ্বংস, আবাসস্থল এর বিভাজন, পরিবেশ দূষন, জলাশয় দূষণ, ভরাট সহ বিভিন্ন কারণে হারাচ্ছে এই পাখিরা। যেমন ধরুন আমাদের এই ঢাকা শহরের কথাই।
২০১৭-১৮-১৯ সালের দিকে নিয়মিত যেতাম পূর্বাচল, খিলখেত, আফতাবনগর আর দিয়াবাড়িতে পাখি দেখতে। তখনও এখানে দেখতে পেতাম বিভিন্ন ধরনের পরিযায়ী জিরিয়া, বাটান, বাজার্ড, কাবাসি, বুনোহাঁস, খঞ্জন, মাছমুরাল এমনকি ছোটকান পেঁচা। এছাড়া আরও বিভিন্ন রকম পরিযায়ী গায়ক পাখি। দেখতে পেতাম পান্থপরিযায়ী আমুর ফ্যালকন।
কিন্তু এই সময়ে এসে তাদের অনেককেই আর আগের মতো দেখা যায় না। ঐ পাখিদের অনেকের জায়গা দখল করে নিয়েছে উচু উচু বিল্ডিং। এছাড়া নদীগুলো ক্রমেই হচ্ছে দূষিত। জলাশয় গুলোতে নেই আগের জৌলুশ। গঙ্গা নিম্নবর্তী জেলা ফরিদপুর এর শহরের জলাশয় গুলোর ও একই অবস্থা।
এছাড়া ঢাকার বাইরের এলাকা গুলোতে পাখি শিকার এর তীব্রতা কিছুটা বেশি। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিকস মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে মানুষের মধ্যে সচেতনতা আগের থেকে বাড়লেও তা সচেতন করছে কেবল একশ্রেণির জনগনকেই। অনেক বড় এক জনগোষ্ঠী থেকে যাচ্ছে সচেতনতার বাইরে। ফলে অবৈধ শিকার নিয়ন্ত্রণ করা পুরোপুরি নির্মুল করা যাচ্ছে না।
বর্তমানে শহরে জলচর পাখিদের জন্য একটি সমস্যা দেখা দিয়েছে যা হলো সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য জলাশয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ কে ধ্বংস করা এবং কৃত্রিম সৌন্দর্য প্রয়োগ। এতে কমে জলচর পাখিদের আবাসস্থল এ প্রকৃতিক খাদ্যোর প্রাচুর্যতা। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে এই পাখিরা।
নগরে সৌন্দর্য বর্ধনের ক্ষেত্রে দেশি বুনো গাছের প্রাধান্য দেওয়া যেতে পারে যেখানে হতে পারে বিভিন্ন দেশি ও পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল। এছাড়া নগরে আবাসিক বা সংরক্ষিত এলাকায় সবুজের আচ্ছাদন বাড়ানো জরুরী যা হবে বুনো পরিযায়ী পাখিদের খাদ্য, বাসস্থান ও বিশ্রামের ক্ষেত্র।
সংরক্ষিত এলাকার বাইরে পরিযায়ী পাখি সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া সময়ের দাবী হয়ে দাড়িয়েছে। বিশেষ করে শহর অঞ্চলে। এই পাখিরা আমাদের অর্থনীতির নীরব কারিগর। যা সম্পর্কে আমাদের হয়তো কোন ধারনাই নেই৷ শহরে এই পাখিদের সংরক্ষণ শুধু পাখিদের জন্য জরুরী নয়, জরুরী মানুষের জন্যও।
লেখক, বন্যপ্রাণী বিষয়ে গবেষণারত ছাত্র, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, ঢাবি।
বিভি/কেএস/এজেড
মন্তব্য করুন: