চেতনার এপার ওপার
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার
আমাদের এ আজব বদ্বীপে চেতনার গুরুত্ব তাৎপর্য, গুরুত্ব, প্রভাব খুবই আজব ও তুলনাহীন। এখানে চেতনার ছোঁয়ায় কয়লা সোনা হতে যেমন দেরি হয় না, তেমনি পাপীষ্ঠ লোক নিষ্পাপ হতেও তেমন সময় নেয় না। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে দামি ও গ্রহণযোগ্য চেতনা হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বাজার চাহিদার কারণে এ চেতনার ব্যবহার গতে এক দশক ধরে বহুগুণে বেড়েই চলছে। তাই এ চেতনার এখন মস্তিষ্কে ধারণ করার বিপরীতে পেশীশক্তি ব্যবহার করে চেতনার ‘অপপ্রয়োগ’ মুখ্য হয়ে উঠেছে। এ চেতনার কসম দিয়েই আমরা একে অপরের কাছ থেকে নিজের অধিকার আদায় করে থাকি। এ চেতনা দিয়েই আমরা প্রতিনিয়ত নিজেকে পাপমুক্ত করার মহৎ কাজটি করে থাকি।
আমাদের এ জনপদের কারো যদি চুরি, দুর্নীতি, খুন ও ধর্ষণের মতো অপরাধ থাকলেও শুধুমাত্র একটি মাত্র চেতনাই আমাদের এসব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার শুধুমাত্র, কেবলমাত্র, একমাত্র ও বিকল্পহীন চাবিকাঠি। এ চেতনার ধারণ করেই ‘বৈধভাবে’ দেশের টাকা বিদেশে পাচার করলে কোন পাপ হয় না। একইভাবে এ চেতনার ধারণকারীরা কাউকে খুন করে কোন পরিবারের চিরকালের জন্য কান্নার খোরাক যোগাড় করে দিলে তাকে নিরপরাধ হিসেবে গণ্য করা দোষের পর্যায়ে পড়ে না।
যেমন কোথাও যদি কোন জঙ্গি কার্যক্রম অথবা মানব বিধ্বংসী চেতনার সন্ধান পাওয়া যায় তখন হাজার কোটি টাকা খরচ করে সে চেতনার শেকড়ের সন্ধান করা হয়। বের করে আনা হয় সে চেতনার উৎপত্তিস্থল। সে অভিশপ্ত চেতনাকে নিঃশেষ করার জন্য রাষ্ট্র তার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে। কিন্তু কোন মানবতাবিরোধী চেতনার সঙ্গে যদি তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কিঞ্চিৎ গন্ধ পাওয়া যায় তখন সেটি এক মহান পুতঃপবিত্র চেতনায় রূপান্তর হয়। আমার এ মন্তব্যকে হয়তো কেউ কেউ পাকিস্তানি চেতনার সঙ্গে শামিল করে ফেলতে পারেন। কিন্তু এতে কেবল আমাকের দোষারোপ করা ছাড়া কোন লাভ হবে না।
২০১৭ সালের ০৩ অক্টোবর সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা বদরুল সিলেটের কলেজ শিক্ষার্থী খাদিজাকে পরীক্ষাকেন্দ্রে যে নিমর্মভাবে কুপিয়ে জখম করেছে সে ঘটনায় বদরুলের কি শাস্তি হলো, তার নামে কয়টি মামলা হলো সে ব্যাপারে নাহয় আলোচনা এখন থাক। কিন্তু বদরুল কোন চেতনার অধিকারী, সে কোন চেতনা ধারণ করে এ নির্মম কাজটি করলো, সেটিই আমার প্রশ্ন। বদরুলের চেতনার সঙ্গে ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে যেসব জঙ্গিরা হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তাদের চেতনার দূরত্ব কতটুকু?
২০১৯ সালের ১৭ অক্টোবর মাতৃভূমি রক্ষার পক্ষে কথা বলার কারণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে রাতভর নির্মম অমানুষিক নির্যাতন করে যারা হত্যা করেছে সে হত্যাকারীদের চেতনার সঙ্গে ২০১৯ সালের ১৫ই মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে হামলা করে ৫০জন নিরীহ মানবকে হত্যাকারীদের চেতনার সঙ্গে আমি কোন পার্থক্য দেখি না।
একইভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও ইডেন কলেজে শিক্ষার্থী নির্যাতনের যারা জড়িত তাদের চেতনাও সেই একই সূত্রে গাঁথা।
একইভাবে ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ দাসের মতো নিরীহ যুবককে যারা প্রকাশ্য দিবালোকে উল্লাসরত অবস্থায় কুপিয়ে হত্যা করেছে তাদের চেতনা ও ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে যারা সিরিজ বোমা হামলা চালিয়েছে তাদের চেতনা সম্পূর্ণ একই। তবুও এ বদরুল, বিশ্বজিৎ ও আবরারের হত্যাকারীদের চেতনা পুতঃপবিত্র। কারণ এ চেতনার সঙ্গে সেসব ব্যক্তিদের স্বার্থ জড়িত, যারা বাংলার এ ভূমিকে লুটপাটের উপনিবেশ হিসেবেই ব্যবহার করে।
কিন্তু খাদিজা, আবরার ও বিশ্বজিৎ দাসের ওপর যারা নিমর্ম নির্যাতন চালিয়েছে তাদের চেতনার সঙ্গে তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নির্দিষ্ট পারিবারিক স্বার্থের সংযোগ ঘটিয়ে সে চেতনাকে পরিশুদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। তাদের ধ্বংসাত্বক চেতনার অনুসন্ধান ও শেকড়ের সন্ধানের প্রয়োজন অনুভব করেনি রাষ্ট্রে দায়িত্বশীল পর্যায়ের কেউই। কারণ বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে কয়েকটি নির্দিষ্ট পরিবার নিরাপদ থাকলে সমগ্র বাংলার মানুষকে নিরাপদ ভাবা হয়। এ দু’চারটি পরিবারের ঘরে কুপি জ্বাললে বাংলার সমগ্র মানুষেরা আলো পেয়ে যায়। এ দেশের নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি আমাদের পাকিস্তানি চেতনার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে প্রতিনিয়ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেশে সাহেব পাড়া ও বেগম পাড়া গড়ে তোলার অবিরাম চেষ্টায় মত্ত।
লেখক: সংবাদকর্মী
(বাংলাভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, বাংলাভিশন কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার বাংলাভিশন নিবে না।)
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: