• NEWS PORTAL

  • মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

‘পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে মহিষই হতে পারে টেকসই সমাধান’

ডা. নাজমুল হাসান তানভীর

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ৮ এপ্রিল ২০২৪

ফন্ট সাইজ
‘পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রাখতে মহিষই হতে পারে টেকসই সমাধান’

‌‌‌‘আমরা বইষগুলো পাইলা আগুইমু কেমনে, চরে খাওয়াইতে তো বছরে ২ লাখ দেওয়ন লাগে, তার উফরে ডাক্তার নাই নিজে নিজে এডা করি ওইডা করি স্যার।’-কর্মশালার সময় ভোলার খামারি বলছিলেন তার রাখালী জীবনের দুর্ভোগ আর প্রচেষ্টার গল্প। বলবেনই বা না কেন তাদের যে খুঁজে সম্মানিত করার মতো কেউ ছিলো না। রাখালী থেকে আজ ৫০টি মহিষের মালিক যে সে। 

'আডার হেলথ বাংলাদেশ'-এর উদ্যোগ আন্তর্জাতিক মহিষ কর্মশালা-২০২৪ এমনই এক মোহনা যেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন; আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী, ডিএলএস, বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসর, এনজিও, ভেটেরিনারিয়ান, সাংবাদিক, শিক্ষার্থী আর খামারিসহ মোট ১১৭ জন। আয়োজক টিম থেকে সুইডেন ও ইতালি থেকে প্রতিনিধিরা অনলাইনে কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। এছাড়া, ভারত, পাকিস্তান ও নেপাল থেকে জল মহিষ নিয়ে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ৪ জন প্রফেসর কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিলো, "জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশে টেকসই জল মহিষ পালন।" অত্র কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের অভিমত নিয়েছি আমি ভেট তানভীর।

স্বাগত বক্তব্যে প্রফেসর ড. মো. মিজানুর রহমান আগত দেশ-বিদেশের সকল অতিথিদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন এবং আডার হেলথ বাংলাদেশ এর সকল কার্যক্রমের সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, মহিষের বাল্ক মিল্ক সোমাটিক সেল কাউন্ট পেয়েছেন ২,১৭,০০০/মি.লি. যা গাভীতে ন্যাশনাল ম্যাস্টাইটিস কাউন্সিল কতৃক প্রদত্ত আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্য মাত্রা ২০০,০০০/ মি.লি. এর কাছাকাছি ও স্বস্তিদায়ক। গৃহপালিত খামারের চেয়ে বাণিজ্যিক ভিত্তির খামারে এ সোমাটিক সেল কাউন্ট বেশি পাওয়া গেছে। গরু এবং মহিষের সাবক্লিনিক্যাল ওলান প্রদাহে তেমন পার্থক্য নেই, কিন্তু ক্লিনিক্যালে ওলান প্রদাহ মহিষে খুবই কম বা নেই বলেই চলে। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, আডার হেলথ বাংলাদেশ বিগত আট (২০১৬-২০২৪) বছরে কার্যক্রমের ভিত্তিতে দুধে সোমাটিক সেল কাউন্টকে কয়েকটি পর্যায়ক্রমে ভাগ করা হয়েছে।"

এছাড়াও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের আডার হেলথ বাংলাদেশ ল্যবরেটরিতে নিয়মিতভাবে দুধের কালচারাল সেনসিটিভিটি টেস্ট করে ফিল্ডে আন্টিমাইক্রোবিয়াল রেসিসট্যান্স পাওয়া গেছে যার মধ্যে রয়েছে অক্সিটেট্রাসাইক্লিন, এরিথ্রোমাইসিন, পেনিসিলিন, স্ট্রেপটোমাইসিন, সেফট্রিএক্সোন। তাছাড়া মিডলম্যান এবং দুধের কালেকশন সেন্টার থেকেও উক্ত এন্টিবায়োটিকগুলো রেসিসট্যান্স পাওয়া গেছে। ওলান প্রদাহ চিকিৎসার জন্য আডার হেলথ বাংলাদেশের বিগত প্রোজেক্টে ডিসিশন ট্রি তৈরি করা হয়েছে ও গাভীতে আডার হেলথ ম্যানুয়াল এবং সম্প্রতি মহিষের পালনের ম্যানুয়াল তৈরি করা হয়েছে যা আডার হেল্‌থ বাংলাদেশের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। আডার হেলথ ল্যাব থেকে একজন স্টুডেন্ট ইতিমধ্যে ইতালি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেছেন এবং ৬ জন স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।

বাংলাদেশ প্রণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের এর মহাপরিচালক ড. এস এম জাহাঙ্গীর হোসাইন বলেন, "দুধের গুণগত মান ও স্বাস্থ্যসম্মত দুধ উৎপাদনের লক্ষ্য নিয়ে সিভাসু, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সুইডিশ ভেটেরিনারি এজেন্সি, সুইডিশ ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচারাল সাইন্সেস, উট্রেক্ট ইউনিভার্সিটি, ওয়াগেনেন ইউনিভার্সিটি, ইতালিয়ান ন্যাশনাল বাফেলো রিসার্স সেন্টার ও ইউনিভার্সিটি অব মিলানোসহ দেশ-বিদেশের এই আটটি প্রতিষ্ঠানকে সাথে নিয়ে আডার হেলথ বাংলাদেশের পথ চলা শুরু হয়। এই কদিনে বড় অর্জন, ভবিষ্যতে দেশ-বিদেশের গবেষকদের জল মহিষের উপর এরকম মহতী গবেষণাকার্যে বিএলআরআইও সহযোগিতা করবে। জলবায়ুর পরিবর্তনে মানিয়ে চলার উপযোগী হওয়া স্বত্ত্বেও জল মহিষ অবহেলিত হয়ে আছে, তাই মহিষ নিয়ে গবেষণা জরুরি।"

চ্যাটাম হাউজ গ্লোবাল হেলথের এসোসিয়েট ফেলো প্রফেসর ড. নিতীশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, "দেশে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে এবং প্রাণিজ প্রোটিনের সহজ সমাধান হতে পারে দুধ উৎপাদন বৃদ্ধি। সেই লক্ষ্যে উন্নত বিশ্বের ন্যায় জনপ্রতি প্রতিদিন যাতে অন্তত ১ গ্লাস করে দুধ খেতে পারে তা নিশ্চয়তায় আগামী দিনে মহিষে উৎপাদনের বিকল্প নেই। সে লক্ষ্যে বিশ্বের বৈজ্ঞানিক সংগঠনগুলো থেকে এ অঞ্চলের মহিষের জনসংখ্যা ঠিক রাখতে গবেষণায় এখনই বড় অর্থায়ন দরকার।"

বাংলাদেশ এক্রিডিশন কাউন্সিলের সদস্য প্রফেসর ড. গোলাম শাহী আলম বলেন, "পুরো বিশ্বের ৭৪% মহিষই দক্ষিন-পূর্ব এশিয়াতে। ২০৫০ এ আমিষের চাহিদা ৭০% বাড়বে সাথে সাথে জলবায়ুতে গ্রিনহাউজ নির্গমন ৮০% বাড়বে। পানির উচ্চতা বেড়ে যাবে, ভারসাম্য ঠিক রাখতে জল মহিষই হতে পারে একটি টেকসই সমাধান। তাই, মহিষের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার বৈজ্ঞানিক কারণগুলো বের করা এখনই সময়ের দাবী। তিনি মহিষের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সমন্বিত গবেষণার জোর আহ্বান জানান।"

সুইডিশ ভেটেরিনারি এজেন্সি, এর স্টেট ভেটেরিনারিয়ান এবং সুইডিশ ইউনিভার্সিটি অব এগ্রিকালচারাল সাইন্সেসের সহযোগী অধ্যাপক ড. ইলভা পার্সন ডক্টরালে ও মাস্টার্সে গবেষণারত রিসার্চ এসিস্টেন্টদের অবদানের কথা স্মরণ করেন। বেশ কিছু বছর ধরে তিনি সিভাসু এবং সিভাসুর প্রফেসর ড. মিজানুর রহমান কে সাথে নিয়ে আডার হেলথ নিয়ে গবেষণা কার্যের পরিচিতি তুলে ধরেন এবং ভূয়সী প্রশংসা করেন। এশিয়া মহাদেশীয় এই রিসার্চের উন্নতিতে নতুন মাত্রায় জল মহিষ নিয়ে গবেষণাগুলোর সাফল্য সবধরণের সহযোগিতার আশ্বাস দেন।"
বাংলাদেশ বাফেলো এসোসিয়েশনের সভাপতি প্রফেসর ড. মোঃ ওমর ফারুক উল্লেখ করেন, "আমার ৪০ বছরের রিসার্চ এর উপর কথা বলছি, আগামী ১০-১৫ বছরের মধ্যে মহিষ পালনে লাভই দেখছি এবং আপনারা নি:সন্দেহে খামার করতে পারবেন। জলবায়ুর এহেন পরিস্থিতিতে আরো গবেষণা দরকার উপমহাদেশীয় উৎপত্তি পাওয়া এই প্রাণীটিকে নিয়ে। চারণভূমি ৪০ বছরে ৯০% কমেছে আগামী ১০ বছরে ৩% এ চলে আসবে। মহিষ উৎপাদনে চরগুলো রক্ষা করা জরুরি ও টেকসই মহিষ পালনে আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এখনই সচেষ্ট হতে হবে চারণভূমি রক্ষায়।"

ডিএলএসের মহাপরিচালক ডা. রেয়াজুল হক বলেন, "গরুর দুধের চেয়ে মহিষের দুধ ভালো তাতে কোন সন্দেহ নাই, ভারতে মোট দুধ উৎপাদনের ৬০% ই মহিষ থেকে আসে। আমাদের দেশের নব্য গজানো চরগুলোর দায়িত্ব দেয়া হয় ভূমি মন্ত্রণালয়ে, এই অনুর্বর চর গুলোতে যেন মহিষ চাষ করে ধীরে ধীরে উর্বর করানো যায় সেই ব্যাপারে কাজ করছি, শীঘ্রই শুভসংবাদ পাবেন আশা রাখি। ২০৪১ সনের স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে মহিষের জাত উন্নয়ন ও গুণগত খামার গঠনে আমি সহযোগিতা করবো কথা দিচ্ছি। তিনি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন আয়োজকদের প্রতি।"

অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রফেসর ড. মোঃ আহসানুল হক বিগত বক্তাদের দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য উল্লেখ করে বলেন যে, মহিষ পালন আমাদের সংস্কৃতির সাথে জড়িত ও আসন্ন জয়বায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিরসনের মাধ্যমে দেশের দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের চাহিদা নিশ্চিতকরণে একটি কার্যকরী সমাধান হতে পারে। তিনি মহিষ পালনের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার বাস্তবভিত্তিক আলোচনার প্রয়োজনীয়তার সাথে এই কর্মশালার গবেষণার ফলাফলের সামঞ্জস্যতা তুলে ধরেন ও কর্মশালায় অংশগ্রণকারী উপস্থিত সকলের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। 

তাছাড়া আডার হেলথ প্রজেক্টে গবেষণারত পিএইচডি এবং মাস্টার্সে শিক্ষার্থীদের কাজগুলো তুলে ধরা হয়। চার দিনের এই কর্মশালায় ১৯ টি ওরাল প্রেজেন্টেশন ও ৮ টি গ্রুপ আলোচনায় উঠে আসে বাংলাদেশ ও পার্শবর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল ও ইউরোপীয় দেশ ইতালিতে জল মহিষের অবস্থান, এই আলোকে বাংলাদেশে জল মহিষের রোগ ব্যবস্থাপনা, আবদ্ধ মহিষ পালন, অভ্যন্তরীন সমস্যা, মহিষ পালনে জলবায়ুর প্রভাবসহ প্রায় সকল বিষয়ে প্রবলেম বেইসড লার্নিং, গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের অংশগ্রহণকারীরা বিজ্ঞানসম্মত তথ্যাদি আলোচনা করেন। আলোচনায় মহিষপালনে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অন্তরায় হিসাবে উঠে আসে মহিষের চারণভূমির স্বল্পতা, ঘরে আবদ্ধ পদ্ধতিতে মহিষ পালন সম্পর্কিত কিছু সীমাবদ্ধতা, মহিষের সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব যেমন, হেমোরেজিক সেপ্টিসেমিয়া (গলা ফোলা), এনথ্রাক্স (তড়কা), এলএসডি, এফএমডি (ক্ষুরারোগ), মহিষের বাছুরের উচ্চ মৃত্যুর হার, ভ্যাক্সিন ও ভেটেরিনারি সেবার অপর্যাপ্ততা, কম উৎপাদন ক্ষমতা, ইনব্রিডিং ইত্যাদি। খামারি ও অভিজ্ঞ অংশগ্রহণকারীরা এই প্রতিবন্ধকতার সময়োপযোগী বিভিন্ন সমাধান নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেন যেমন, জলবায়ু-বান্ধব প্রানীপালন নিয়ে সরকারের বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা, ঘরে আবদ্ধ পদ্ধতিতে মহিষ পালনে উদ্বুদ্ধকরণ, প্রচারণার মাধ্যমে তরুন উদ্যোক্তাদের সতেচন করা, জিনগত উন্নতির মাধ্যমে অধিক উৎপাদনশীল মহিষের সংখ্যা বৃদ্ধি, ওলান স্বাস্থ্য ও দুধের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, সঠিক ব্যাবস্থাপনার মাধ্যমে গ্রীন হাউজ গ্যাসের নিঃসরণ কমানো ও ভেটেরিনারি সেবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিস্তৃত করা ও মহিষের দুধ ও মাংসের বাজার ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করা। 

কর্মশালার আয়োজকবৃন্দ সমাপনী বক্তব্যে উল্লেখ করেন যে, আলোচিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও কর্মশালা থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন পরামর্শ যথাযথ মাধ্যমে মহিষ সম্পর্কিত উচ্চ নীতি-নির্ধারকদের সাথে প্রদান করা যেতে পারে যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশে মহিষের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে।

লেখক: ডা. নাজমুল হাসান তানভীর, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স

বিভি/টিটি

মন্তব্য করুন:

Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2