পদ্মা সেতুতে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন?

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণপ্রকল্প বর্তমান সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৃহৎপ্রকল্প, যার মাধ্যমে ঢাকাসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের সাথে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ উন্নয়নের নিমিত্তে বিশেষ করে মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার মাওয়া পয়েন্ট হতে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলার জাজিরা পয়েন্ট পর্যন্ত সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত এ সেতু দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, যোগাযোগ ও শিল্পবিকাশে বিশেষ অবদান রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত ২৫শে জুন পদ্মা সেতুর শুভ উদ্ভোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণা সম্পর্কে লিখতে গেলে তার পটভুমিকা জানা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২০০৯-২০১০ সালে পদ্মা বহুমুখী সেতুনিমার্ণ প্রকল্পপ্রাক সম্ভাব্যতা যাচাইকালে উহার Environmental Action Plan (EAP) প্রতিবেদন তৈরীর জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান Maunsell/AECOM New Zealand Limited কে নিয়োগ করে এবং উক্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রকল্প এলাকার বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্রের প্রাথমিক সমীক্ষা (Baseline Survey) সমাপ্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করে। তারা পদ্মা নদীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য একটি সংরক্ষিত এলাকা স্থাপন করার সুপারিশ করে। পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ার পর ২০১৫-২০১৬ সালে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ পুনরায় বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ জরিপ, প্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের উপর নির্মাণকাজের ক্ষতিকর প্রভাব পরিবীক্ষণ ও হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ করার মাধ্যমে Biodiversity Baseline Survey, Biodiversity Monitoring Plan, Protected Area Location Identification and Protected Area Establishment Plan প্রতিবেদন তৈরীর জন্য আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠান Agriconsulting S. p. A. Rome, Ital এবং SODEV Consult International Ltd, Dhaka, Bangladesh কে নিয়োগ প্রদান করে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সমূহের প্রতিবেদন অনুসারে সেতু নির্মাণকালে নদী ও জলাভূমি পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকার হবেএবং এতে অনেক বিপন্ন প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হবে বলে ধারণা করা হয়।
তাছাড়া, পদ্মানদী বাংলাদেশের সমাজসভ্যতা ও অর্থনীতির পাদপিঠ। সেই নদীবক্ষে সেতুনির্মাণ দেশের যোগাযোগব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। অতীশ দীপংকর, স্যারজগদীশ চন্দ্র বসুর এই জন্মভূমি এলাকায় পদ্মা সেতু। নির্মাণ প্রকল্পকে পরিবেশ সম্মত এবং সুষম করার নিমিত্তে “জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রম” এক উল্লেখযোগ্য কর্মযঞ্জ। ডিসেম্বর ২০১৮ তে সোদেভ কনসাল্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের সাথে জীববৈচিত্র্য মনিটরিং ও অভয়ারণ্য ঘোষণার জন্য যাবতীয় কার্যক্রম ও অভয়ারণ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা তৈরি করার চুক্তি সম্পন্ন হয়। জানুয়ারি ২০১৯ইং থেকে “জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রম” শুরু হয় যা ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত চলবে।
প্রকল্প এলাকার উল্লেখযোগ্য প্রতিবেশ বৈচিত্র্য হলো জলাভূমি, নলখাগরা বন, কর্দমাক্ত প্লাবনভূমি, বালিয়ারী, বালু সৈকত, চরাঞ্চল, নদীতীর, প্লাবনভূমি, খাড়ী / কূম, মূল শ্রোতধারা, শাখানদী, উপ-শাখানদী, খাল ও বিল। প্রকল্পের মাইলস্টোন মিটিং-এর সিদ্ধান্ত অনুসারে বিভিন্ন প্রতিবেশ থেকে কিছু সংখক প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি পরিবেশ নির্দেশক হিসেবে নির্বাচন করে যার মাঝে রয়েছে এক প্রজাতির উভচর, দু প্রজাতির সরিসৃপ, চার প্রজাতিরপাখি, দু প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ছয় প্রজাতির মাছ ও পাঁচ প্রজাতির উদ্ভিদ যা নিয়মিতভাবে সারা বছর পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তাছাড়া ঋতু পরিবর্তন, বন্যা, ও স্থানীয় লোকজনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য জীববৈচিত্র ও পরিবেশের উপর কি প্রভাব পড়ছে সেই বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ ও নিরুপন করা।
পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণার জন্য বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ-পদ্মাবহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প বেশ কিছু জায়গা অধিগ্রহণ করে যেখানে dredged material dump করা হয়। সেই সব অধিগ্রহণকৃত জায়গা ও সরকারি খাস জায়গা নিয়ে বাংলাদেশ বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২ এর ১৩(১), ১৩(২), ২০(২) ও ২০(৩) ধারার ক্ষমতাবলে পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ঘোষণার প্রস্তাবকরা হয়, যা সরকার অনুমোদন করে এবং ২৬শে নভেম্বর ২০২০ইং সালে গেজেটের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। অভয়ারণ্যের মোট এলাকা ১১৭.৭২ বর্গ কিলোমিটার যার তিনচতুর্থ অংশ পানি ও বাকিটা স্থল ভাগ। “কোর”এলাকার আয়তন ৮১.১৯ বর্গ কিলোমিটার ও “বাফার”এলাকার আয়তন ৩৬.৩০ বর্গ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের চৌহদ্দী উত্তরে ভাগ্যকূল, বাঘড়া, মেদিনীমন্ডল, কান্দিপাড়া, মাওয়া, কুমারভোগ ও তেউতিয়া; পূর্বে লৌহজং উপজেলা সদর, পালের চর, নদী ও ঢংগীকান্দি; দক্ষিণে পালের চর, পূর্ব নাওডোবা, নাওডোবা, কাঁঠালবাড়ি, মাতবরের চর ও ঢংগীকান্দি ও পশ্চিমেবান্দরখোলা, আড়িয়াল খাঁ নদীরমুখ, খালপাড় ও নারিকেলবাড়ি।ভাগ্যকুল, নারিকেলবাড়ী, বাগড়া, আড়িয়ালখা, চর জানাজাত, রঞ্জিতখা, কাওয়ালীপাড়া, জলসেন, তারপাশা, পাইনপাড়া, নাওডোবা, পালের চর, মাঝের চর, মাতবরের চর, মেদেনীমÐল, তেওতাএবংধংগীকান্দা এলাকারনদী, চর তীরজলাভূমি ও প্লাবনভূমি প্রতিবেশব্যবস্থায় পদ্মা সেতু বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য স্থাপন, এদেশের নদী প্রণালী প্রাকৃতিক ঐশর্য্য এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণের মাইলফলক। নদী, চর, তীর এবং প্লাবনভূমির প্রতিবেশ প্রজাতি এবং কৌশলগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবহার এই কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য।
প্রাণীবৈচিত্র্যে রয়েছে ২৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১১২ প্রজাতিরপাখি, ৩৫ প্রজাতিরসরীসৃপ, ১৬ প্রজাতির উভচর, ৮৯ প্রজাতির মাছ, ২০ প্রজাতির প্রজাপতি, ২৯ প্রজাতির শামুক/ঝিনুক, মৈামাছি-সহ অগনিত প্রজাতিরকীটপতংগ ও ৩২১ প্রজাতিরগাছ ও লতা গুল্ম।
প্রজাতি বৈচিত্র্যর মাঝে রয়েছে গাংগেয় শিশু/শুশুক, শিয়াল, খাটাশ, উদ্বিড়াল, মেছোবাঘ, বন বিড়াল, বেজি, ভোদর, বাগডাশ, দেশী ও পরিযায়ি জলচর পক্ষিকূল। সরীসৃপ প্রাণীর মধ্যে আছে গুই, দারাজসাপ, খয়ে গোখরা, মেটেসাপ, ঢোরাসাপ, টিকটিকি, গিরগীটি, গুইল, জলচরসাপ, গাংগেয় কাছিম,সুন্দি কাছিম, কড়িকাইট্টা, হলুদ কচ্ছপ, ও বড় ঘাস অঞ্জন। উভচর প্রাণীর মধ্যে রয়েছে ঘরকুনো ব্যাঙ, সোনাব্যাঙ, কটকটিব্যাঙ, ঝিঝিব্যাঙ, সবুজব্যাঙ ও গেছোব্যাঙ। ইলিশ, পাঙ্গাস, চিতল, আইড়, রিটা, বাঘাইরসহ মিঠাপানির মৎস সম্পদসহ ঝিনুক, শামুখ, কিটপতঙ্গ। উদ্ভিদের মাঝে জল পলাশ, হীজল, বরুন, কদম, কাশ, নল, বন তুলশী, ক্ষুদেবট, শতমূল, বুনোধান, ঝাউ-তৃন, দল, দাম, ঘাস গুল্ম, লতা, ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে প্রাচুর্য্যময়। এর মধ্যে কিছু প্রজাতি আন্তর্জাতিকভাবে বিপন্ন যেমন: গাংগেয় শিশু/শুশুক, মেছো বাঘ, ভোদর। তাছাড়া কিছু পরিযায়ি পাখি আছে যারা সুদূর হিমালয়ের পাদদেশ থেকে পদ্মার চরে বিচরণ করে। এ বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যটি আমাদের জাতীয় মাছ ইলিশ-সহপাঙ্গাস, চিতল, আইড়, রিটা, বাঘাইর-এর বিচরণ, পরিযায়ন ও প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবেও চিহ্নিত।
উল্লেখযোগ্য পাখিরমধ্যে আছে বড় শরালি, পাতিশরালি, গাঙচিল, ভূবনচিল, তিলাবাজ, ধলাকাপাসি, পাকড়াকাপাসি, তুর্কিবাজ, শঙ্খচিল, কাঠঠোকরা, পাঁকড়া কাঠঠোকরা, বসন্তবাউরি, হুদ্হুদ্, নীলকন্ঠ, ছোট মাছরাঙ্গা, ধলাগলা মাছরাঙ্গা, পাঁকড়া মাছরাঙ্গা, বড়পানকৌড়ি, ছোটপানকৌড়ি, ডাহুক, খয়রামাথাসুইচোরা, নীললেজসূঁইচোরা, সবুজসূঁইচোরা, পাপিয়া, বৌকথা কও, বাংলাকুবো, আবাবিল, সুইবাতাসি, লক্ষী পেঁচা, খোঁড়লেপ্যাঁচা, ছোটকানপ্যাাঁচা, তিলাঘুঘু, রাজঘুঘ, দল পিপি, পাতিজিরিয়া, হটটিটি, লাললতিকা, জুটিশালিক,গাঙশালিক, টিয়া,কাঠ-ঠোকরা, রাতচরা, ছোটবগাখয়রাবগলা, হুলদে বগলা, বড়বগা, গোবক, শামুখ খোল, কসাইপাখি, বাংলাবাবুই, দাগিবাবুই, দেশিবাবুই,ইত্যাদি।
এখানে শীতকালীন পরিযায়ী পাখির মধ্যে খয়রাচকা-চকি, লেঞ্জাহাঁস, মেটেরাজহাঁস, দাগিরাজহাঁস,পাতিহাঁস, ওসপ্রেও পেরিগ্রিন ফ্যালকন ইত্যাদি উলেখযোগ্য। দেশী হাসদের মাঝে সরালি ও পাতি হাঁস চরে বাসা বাঁধে।
বিভিন্ন ধরনের মাছের মধ্যে ইলিশ, বোয়াল, পাঙ্গাস, বাইলা,গলদা চিংড়ি,আইর, টেংরা, রিটা, চিতল, বাইম, পুঁটি, মেনি/রয়নাভেদা, রুই, কাতল, ঘাউরা, পাবদা, চাপিলা, কৈ, টাকি ও বাতাসি উল্লেখযোগ্য।
এই অভয়ারণ্যটিতে নলখাগড়া ও কাশবন সমৃদ্ধ জলাভূমি বনের বৈশিষ্ট রয়েছে। এখানে রয়েছে ৩২১ প্রজাতির বৃক্ষরাজি লতাগুল্ম ও ঘাসজাতীয় উদ্ভিদ। এর মধ্যে নলখাগড়া, কাশ, হিজল, করচ, বরুণ, মান্দার, কদম, পিটালী, শিমুল, ছাতিম, রেইন্ট্রি, বাঁশ, বেত, কড়ই,পানিবাজ উল্লেখযোগ্য।
এই সকল গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য সুরক্ষার জন্য পদ্মাসেতু সন্নিবেশিত এলাকায় পদ্মাসেতু বন্যপ্রানী অভয়ারণ্য স্থাপন যৌক্তিক ও এর রক্ষণাবেক্ষণ দেশ ও জাতির কর্তব্য। তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রেও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করবে।
তাই বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ পরিবেশগত ক্ষতিহ্রাস ও পদ্মা নদীর জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এই এলাকা সংরক্ষণ, সুষম উন্নয়ন করার জন্য পদ্মা সেতু বন্যপ্রানী অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। সুতরাং, রক্ষিত এলাকা করার মূলউদ্দেশ্যগুলো হলো- পদ্মানদীতে সেতু নির্মাণের ফলে নেতিবাচক, পরিবেশগত প্রভাব প্রশমন করা, পদ্মা নদীর জীববৈচিত্র্যের দীর্ঘ মেয়াদী সংরক্ষণ করা, পদ্মা নদী জলাভূমির বাস্ততন্ত্রের কার্যকারিতা বজায় রাখা, সংকটাপন্ন, বিপন্ন প্রজাতিদের সংরক্ষণ করা, মাছ, মেছো বিড়াল ও গাংগেয় শুশুকসহ বন্যপ্রাণীর প্রজনন ক্ষেত্র ও পরিযায়ী পথের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, নাগরিকদের জন্য প্রাকৃতিক পর্যটন সুবিধা প্রদান, প্রকৃতি সংরক্ষণের জন্য গবেষণা, শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা এবং স্থানীয় জনগণের জীবিকা নির্বাহের জন্য জীবসম্পদের টেকসই ব্যবহার সহজতর করা।
লেখক:
টিমলিডার, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কার্যক্রম,
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প
সোদেভ কনসাল্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
বিভি/কেএস
মন্তব্য করুন: