ডাক্তারদের যেন মরেও শান্তি নাই!

ডা : জেবা জামান খান
কয়েকদিন আগে, আমার মেডিকেলের একজন সিনিয়র আপু, তারই একজন কলিগ-ডাক্তারের ডেঙ্গী ফিভারে মৃত্যুর খবরটি শেয়ার করলেন। আমি যখন আপুর লেখাগুলো পড়ছিলাম,কান্না থামাতে পারিনি। ডাক্তার ভাইটি তার মৃত্যুর আগেও ডিউটি করে যাচ্ছিলো। আমাদের দেশে এই সময়টাতে, ডেঙ্গী ফিভারে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার বাড়ছেই। আমাদের ডাক্তার ভাইটিও আক্রান্ত হলেন, এরপর কি থেকে কি হয়ে গেলো, অনেকটা বোঝার আগেই যেনো না ফেরার দেশে চলে গেলেন।
আমি কিছুক্ষণ বসে বসে ভাবলাম, এই ডাক্তারের হাতে কতো রোগী সুস্থ হয়েছে, হয়তো সামনেও হতো। কিন্তু হায়াত-মউত এর মালিক আল্লাহ, আমাদের হাতেতো কাউকেই মৃত্যু থেকে ফেরাবার পথ নেই। আমরা ডাক্তাররা চেষ্টা করে যাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত, যাতে একজন রোগীর জীবন রক্ষা পায়, মানুষটা যেনো বেঁচে যায়..।
অবাক হয়ে দেখলাম আর শুনলাম আশেপাশের কিছু মানুষের কথা। আশেপাশে বলতে, ঠিক আমাদের কাছাকাছি যে মানুষগুলো আছে, তাদেরকেই বোঝাচ্ছি। এরা বলছে, 'সে না ডাক্তার ছিলো? তার আবার ডেঙ্গু জ্বর হয় কি করে? সে কি ডেঙ্গুর ট্রিটমেন্ট জানেনা? এতো মানুষের ট্রিটমেন্ট করলো আর নিজের ট্রিটমেন্টটা ঠিকমতো করতে পারলোনা? '
এসব শুনে আমি বেশ মর্মাহত।
ডাক্তারের মৃত্যু আমাকে যতোটা না মর্মাহত করেছে, তার থেকেও অনেক অনেক বেশি।
ভাবি, এই মানুষগুলোর চিন্তাভাবনা আসলেই কি বদলানো সম্ভব?
ছোটবেলা থেকে আমি বেশ ভালোই প্রতিবাদী স্বভাবের। অন্যায়,অবিচার,ভুল বা খারাপ কিছু দেখলে আমি সবসময়ই চেষ্টা করি, আমার জায়গা থেকে যতোটা পারা যায়, প্রতিবাদ করতে।
কিন্তু এই আজব চিন্তাধারার মানুষগুলোকে কি করে বোঝাবো?
যেখানে আমি নিজেই কতোবার এই ধরণের মানুষের আজব কথাবার্তার শিকার হয়েছি।
পিরিয়ড ক্র্যাম্পস হোক বা মাইগ্রেইন পেইন, দুটোই আমার হয়। আর বাকী কোনোকিছুর কথা নাইবা বলি।
'কেনো হয়? তুমি না ডাক্তার? ট্রিটমেন্ট জানোনা? সবার ট্রিটমেন্ট করে বেড়াও, আর নিজের মাথাব্যথা, পেটব্যথা ঠিক করতে পারোনাই এখনো?'
পরিবারের মাঝেই শিক্ষিত নির্বোধ মানুষ থাকে কিছু, যারা এ ধরণের মন্তব্য করে। ভেবে দেখেন, হয়তো আপনাদেরও কারো কারো পরিবারে কিংবা আশেপাশে এ ধরণের লোকজন আছে।
কোনোভাবে যদি এদের বোঝানো যেতো যে, ডাক্তাররাও মানুষ। ডাক্তারের কাজ অন্যের চিকিৎসা আর সেবা করা, সেটা নাহয় ঠিকাছে, কিন্তু এই ডাক্তাররা নিজেদের শরীর মনের স্বাস্থ্যের কথা ভুলে গিয়ে সবাইকে সেবা দিয়েই চলেছে, নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে। ডাক্তারদের শরীর মনের স্বাস্থ্যের খেয়াল কে রাখে? কয়জন রাখে..?
হয়তো সব ডাক্তার এক রকম নয়। যেমন হাতের পাঁচটা আঙুল একরকম নয়।
তবুও, ডাক্তাররা যে তার রোগীদের মতোই মানুষ, রোগীরা যেমন নানা রোগে আক্রান্ত হয়, তেমনি ডাক্তারদেরও রোগ হয়, ডাক্তাররাও রোগীর সেবা করতে করতে কখনো কখনো অসুস্থ হয়ে পড়ে, হতেই পারে, একই রক্তমাংসের মানুষ তো, তাইনা?
ডাক্তারদেরও ডিপ্রেশান হয়; হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশান, ক্যান্সার সহ আরো নানারকম রোগ হয়।
মানুষ তো, তাই রোগ বালাই মৃত্যু থেকে ডাক্তাররা মুক্ত নয়। বরং, সারাক্ষণ রোগ জীবাণুর মাঝে থাকে বলে, ডাক্তারদের নানারকম ইনফেকশাস ডিজিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় আরো অনেক অনেক গুণ বেশি।
ভেবে দেখেন, এই যে একটা প্যান্ডেমিক এলো, কভিড ফ্রন্টলাইনার হিসেবে যারা কাজ করেছে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছে প্রত্যেকে। কতোজন ডাক্তারসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, সেই লিস্ট টা কি আছে এদেশের সবার কাছে?
আমি একজন ডাক্তার। কভিডের সময়ে আমিও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একজন ফ্রন্টলাইনার হিসেবে কাজ করে গেছি।
কভিডে আমার পরিবারের ৫ জনকে হারিয়েছি এখনো পর্যন্ত, আর গতো বছর ডেঙ্গী ফিভার/ডেঙ্গুজ্বরে মারা যায় আমার একটা কাজিন, যে ছিলো সদ্য বিবাহিত। এখনো ওর সুন্দর মুখটা আমার চোখে ভাসে। নামাজে বসে সবসময় আমি সবার জন্যে দোয়া করি।
যারা ডাক্তারদের পিছে পড়ে থাকেন, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, হয়তো সব ডাক্তার একরকম না। না কাজে, না স্বভাবে। ডাক্তার না, অন্য কোনো পেশার মানুষদের ক্ষেত্রেও যদি বলি, একই কথা বলবো। আপনাদের আজব চিন্তাধারা আর কথাবার্তার কারণে, ডাক্তারদের যেন মরেও শান্তি নাই।
ডাক্তারের জায়গায় একটু এম্প্যাথি নিয়ে নিজেকে বসিয়ে দেখুন, হয়তো আপনাদের একটু হলেও বোধদয় হতে পারে।
যখন রোগাক্রান্ত হয়ে হতাশ হয়ে পড়েন, যান কিন্তু ওই ডাক্তারের কাছেই। বিশ্বাস করেন আর নাইবা করেন, ডাক্তাররা আপনার শত্রু না। কাজেই, তাদের ন্যূনতম সম্মান ও শ্রদ্ধাটুকু পাওয়া উচিৎ সবার কাছ থেকেই।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যসেবার মান আরো অনেক অনেক উন্নত হোক, এটা আমার প্রত্যাশা।
সবাই ভালো থাকুন, অন্যকে ভালো রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন। সচেতন থাকুন, সুস্থ জীবন যাপন করুন।
নিরন্তর শুভকামনা।
মন্তব্য করুন: