জাতির সূর্যসন্তান বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের জন্মদিন আজ
জাতির অন্যতম সূর্যসন্তান বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামালের ৭৮তম জন্মদিন আজ। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মৃত্যুঞ্জয়ী সৈনিক মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলার দৌলতখান উপজেলার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
সেনাবাহিনীর হাবিলদার হাবিবুর রহমান ও গৃহিনী মালেকা বেগমের দুই পুত্র ও তিন কন্যার মধ্যে মোস্তফা কামাল ছিলেন সবার বড়। মোস্তফা কামাল পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারেননি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর উচ্চ মাধ্যমিকে দুই—এক বছর অধ্যয়ন করেন।
মোস্তফা কামালের ছেলেবেলা পিতার কর্মস্থল কুমিল্লা সেনানিবাসে কেটেছে। বিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার চেয়ে সেনানিবাসে সেনাদের কুচকাওয়াজ, মার্চপাস্ট ইত্যাদি ভালো লাগত।
ক্রমেই তিনি সেনাবাহিনীর একজন সদস্য হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন এবং স্থির করেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিবেন। ২০ বছর বয়সে হঠাৎ করেই মোস্তফা কামাল বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। পরে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে চাকরি চূড়ান্ত হওয়ার পরে সে তার পিতা—মাতার সন্ধান পান। এর আগে ১৯৬৭ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরিগ্রহণ করেন।
তিনি ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। ১৯৭১-এর প্রথম দিকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। তখন সারাদেশে যুদ্ধের বিভৎসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। সেনানিবাসগুলোতে অবস্থা উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কুমিল্লা—আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে এগুতে থাকে।
১৮ই এপ্রিল পরদিন ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দরুইন গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর মর্টার ও আর্টিলারীর গোলাবর্ষণ শুরু করলে মেজর শাফায়াত জামিল ১১নম্বর প্লাটুনকে দরুইন গ্রামে আগের প্লাটুনের সাথে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। মোস্তফা কামালের সাহস, বুদ্ধি ও কর্মতৎপরতা দেখে মেজর শাফায়াত জামিল তাকে যুদ্ধকালীন সময়ে মৌখিকভাবে ল্যান্সনায়েকের দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন। সে অনুসারে মোস্তফা কামাল ১০জন সৈনিকের সেক্টর কমান্ডার হন। ১১নম্বর প্লাটুন নিয়ে হাবিলদার মুনির দরুইনে পৌঁছেন। সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল তার নিকট থেকে গুলি নিয়ে নিজ পরিখায় অবস্থান গ্রহণ করেন। বেলা ১১ টার দিকে শুরু হয় শত্রুর গোলাবর্ষণ।
সেই সময়ে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। সাড়ে ১১টার দিকে মোগরা বাজার ও গঙ্গা সাগরের শত্রু অবস্থান থেকে গুলি বর্ষিত হয়। ১২টার দিকে আসে পশ্চিম দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ। প্রতিরক্ষার সৈন্যরা আক্রমণের তীব্রতায় বিহ্বল হয়ে পড়ে। কয়েক জন শহীদ হন। মোস্তফা কামাল মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন। তার পূর্ব দিকের সৈন্যরা পেছনে সরে নতুন অবস্থানে সরে যেতে থাকে এবং মোস্তফাকে যাবার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু তাদের সবাইকে নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগের জন্য মোস্তফা পূর্ণোদ্যমে এল.এম.জি থেকে গুলি চালাতে থাকেন। তার ৭০গজের মধ্যে শত্রুপক্ষ চলে এলেও তিনি থামেননি।
মোস্তফার ক্রমাগত নিখুঁত ফায়ারে পাকিস্তানিদের প্রায় ২০—২৫ জন হতাহত হন এবং তাদের সম্মুখ গতি মন্থর হয়ে পড়ে। পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে মোস্তফার অবস্থানের উপরে মেশিনগান এবং মর্টারের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এক পর্যায়ে মোস্তফার এল.এম.জি.—র গুলি নিঃশেষ হয় এবং তিনি মারত্মক ভাবে জখম হন। তখন পাকিস্তান বাহিনীর সৈনিকরা ট্রেঞ্চে এসে তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। স্থানীয়রা ট্রেঞ্চের কাছে গিয়ে দেখতে পায় বুলেটের আঘাতে ঝাঁঝরা ও বেয়নেটবিদ্ধ মোস্তফা কামালের মৃতদেহ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার দরুইন গ্রামে তার শাহাদাত স্থানের পাশেই ওই গ্রামের জনগণ তাকে সমাহিত করেন। সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
মৃত্যুর সময় তিনি বাবা—মা, স্ত্রী দেড় মাস বয়সী ছেলে, তিন বোন ও এক ভাই রেখে গেছেন। ১৯৯৫ সালে ২৪ বছর বয়সে ছেলে মোশারেফ বাচ্চু মারা যান। ২০০৬ সালে স্ত্রী পেয়ারা বেগম, ২০০৫ সালে বাবা হাবিবুর রহমান ও ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মারা যান তার মা মালেকা বেগম। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী বীরশ্রেষ্ঠের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মারা যান। বর্তমানে তার দুই বোন ও ছোট ভাইয়ের দুই ছেলে এবং দুই মেয়ে জীবিত রয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক পদক বীরশ্রেষ্ঠ পদক দেওয়া হয় মোহাম্মদ মোস্তফা কামালকে। এছাড়া ভোলা সদর উপজেলার আলীনগর ইউনিয়নে জেলা পরিষদের তত্ত্বাবধানে বীর শ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্মৃতি জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও ভোলা শহরে বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল বাসস্ট্যান্ড নির্মাণ করা হয়। ঢাকার কমলাপুরে (বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়াম) তার নামে একটি ফুটবল স্টেডিয়ামের নামকরণ করা হয়েছে।
বিভি/এজেড




মন্তব্য করুন: