• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫

রাজনৈতিক হাতিয়ার হওয়ার ভয়েই সনদ ছিঁড়ে ফেলেন রণাঙ্গণের মুজিবুল হক

মোহাম্মদ আবদুল্লাহ মজুমদার

প্রকাশিত: ১৬:০৪, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫

আপডেট: ১৬:০৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫

ফন্ট সাইজ
রাজনৈতিক হাতিয়ার হওয়ার ভয়েই সনদ ছিঁড়ে ফেলেন রণাঙ্গণের মুজিবুল হক

মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হক মুজিব

পূর্ব ছাগলনাইয়া গ্রামের ভারত সীমান্তে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে প্রতিরোধ আক্রমণের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ অংশগ্রহণ তিনি। তখনই ছাগলনাইয়ার প্রথম শহীদ আবদুর রাজ্জাক সেখানে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় এসএসসি পরীক্ষার্থী থাকা সত্বেও সেশন পিছিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে দেশ মাতৃকার টানে নিজেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন সেসময়। মুক্তিযুদ্ধের সার্বাধিনায়ক আতাউল গণী ওসমানীর স্বাক্ষরিত সনদে যুদ্ধের পরে ১৯৭২ এর জানুয়ারিতে বেশ কিছুদিন ভাতা পেয়েছিলেন ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার উত্তর আঁধার মানিক গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হক মুজিব। 

পরে ১৯৭২ সালে মুক্তিযোদ্ধদের কোটার মাধ্যমে চাকরি দেয়া ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা চালু করে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের প্রচেষ্টা শুরু হলে একপর্যায়ে ১৯৭৫ সালে তিনি তার একাডেমিক সনদসহ মুক্তিযুদ্ধের সার্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সনদ ছিঁড়ে ফেলে দেন। পরে অবশ্য তাকে কেন্দ্রীয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিল থেকে আরো একটি সনদ দেয়া হয়। এরপর থেকে আর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন ভাতা গ্রহণ করেননি মুজিবুল হক।

পরে কিছুদিন সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত থাকলেও পরবর্তীতে আইনজীবী হিসেবে তিনি চট্টগ্রামের আদালতে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি মনে করেন মুক্তিযুদ্ধের পরে শাসকগোষ্ঠি মুক্তিযোদ্ধদেরকে তাদের অপশাসনের অংশীদার বানানোর কৌশল হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের পরিবারের জন্য চাকরিতে কোটা ও ভাতা ব্যবস্থা চালু করা হয়। এরপর তৎকালিন জাসদের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত বহু মুক্তিযোদ্ধা এ ভাতা ও কোটা ব্যবস্থার বিরোধীতা করেছিলেন। তখন প্রতিবাদ করে অনেক মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হতে চাননি। তবে এদের মধ্যে কেউ কেউ পরবর্তীতে ২০১৮-১৯ সালেও তালিকাভুক্ত হয়েছেন। কারণ যেখানে মুক্তিযুদ্ধ করেননি এমন লোকরাও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হচ্ছেন সেখানে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকার বাইরে থাকাটাও অনেকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে পারেননি।

মুজিবুল হক বলেন, রক্ষীবাহিনী গঠনের পর জাসদের বিপ্লবী গণবাহিনীতে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। পরে ছাগলনাইয়া উপজেলা বিপ্লবী গণবাহিনীতে তিনি বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা হয়েছে তখন দেশের সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের সাথে বৈষম্য করে মুক্তিযোদ্ধদের চাকরি দেয়ার আলাদা ব্যবস্থা মেনে নিতে পারেননি তিনি। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা হয়েছে স্বাধীনের পর আবার দেশের অভ্যন্তরে বৈষম্য সৃষ্টি করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন স্বয়ং মহান মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রতারণা বলেও মনে করেন রণাঙ্গণের এ মুক্তিযোদ্ধা। তার মতে তখনকার এ বৈষম্যের মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধকে সমালোচনার মুখে ফেলেছিলো তৎকালিন শাসক গোষ্ঠি।

তিনি বলেন, ১৯৭২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সকল সরকারই মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এভাবে ব্যবহার হতে হতেই এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারাও সরকারের আনুগত্যকারী একটি জনগোষ্ঠিতে পরিণত হয়েছে, যার কারণে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোন মুক্তিযোদ্ধা সরকার বা শাসক গোষ্ঠির কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে পারেননি। যখনই কোন সরকারের অন্যায় সিদ্ধান্তের বিষয়ে বীর মু্ক্তিযোদ্ধারা আওয়াজ তুলেছে তখনই তাদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে দিয়ে সরকার মুখ বন্ধ করেছে। তিনি মনে করেন এ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্ধ সুযোগ-সুবিধাগুলোই স্বাধীনতার পরে গণতন্ত্রকে সংকোচিত করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার কাজকে সহজ করেছিলো। নাহয় যারা কিছুদিন আগেও জান-মালের আশা না করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে সাধারণ কোন শাসক গোষ্ঠির দমনের কাছে তারা নতি স্বীকার করার প্রশ্নই আসে না।

মুক্তিযোদ্ধারা কোন স্বার্থ ও দল-মতের তোয়াক্কা না করে তখন শুধু দেশের টানেই জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু তখনকার প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা ও জনমত গঠনের কাজে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করায় সময় গড়ানোর সাথে সাথে ১৯৭১ এর ভূমিকার বিতর্ক বৃদ্ধি পেতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক অস্ত্র ও পরিচয়ের একমাত্র উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে যুগের পর যুগ। যা ধীরে ধীরে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এখন অধিকাংশ মানুষ মনে করেন মুক্তিযুদ্ধকে পবিত্র সত্তা হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন সময় ভিন্নমতালম্বীদের অধিকার খর্ব করা হয় এবংএটি গণতন্ত্রের জন্য হুমকিতে রূপান্তরের পাশাপাশি বিভাজনের রাজনীতিকেও উসকে দেয়। পরে একদলীয় শাসনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খাও এক প্রকার মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে যাওয়ার কথা সাক্ষ্য দেয় ইতিহাসের পাতা। এরপর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি গণমানুষের আবেগ ও ভালোবাসা হ্রাস পেতে থাকে যুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই।

সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী  বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে ২০১০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) ৯০টি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সভার মাধ্যমে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাভুক্তি ও যাচাই-বাছাই করা হয়। জামুকা বলছে, এ সময় সভাগুলোতে ১৮ হাজার ১৬৮ জনকে নতুন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। একই সময়ে পাঁচ হাজার ৯৮৭ জন অমুক্তিযোদ্ধার গেজেট বাতিলের সুপারিশও করা হয়েছে। এ তথ্য থেকেই প্রতিয়মান হয় যে অমুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযোদ্ধার খাতায় নাম লেখানোর অভিযোগ এমন আছে তেমনই মুক্তিযোদ্ধা হয়েও তালিকায় নাম না থাকার বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধার পাশাপাশি বহির্বিশ্বে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত তৈরি করেছেন, স্বাধীন বাংলা বেতারে কাজ করেছেন, মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনে ছিলেন, সাংবাদিকসহ যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে মূল মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী বলে বিভাজন করাটাও বৈষম্যের নামান্তর।

মুজিবুল হক বলেন, যুদ্ধ কৌশলের দিক থেকে সারা দেশের গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল গুলোর মধ্যে ছাগলনাইয়া অন্যতম। সে এলাকার তরুণ যাঁরা তখন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে তাদের অধিকাংশই তৎকালিন শাসক গোষ্ঠির হীন প্রচেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তার মতে তিনি একটি অসাম্প্রদায়িক ও সাম্যের বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করতে শুরু করে তখনকার শাসক গোষ্ঠি। তাদের দুঃশাসনের জন্যই তখন জনগণের কাছে অজনপ্রিয় হতে শুরু করেছে তৎকালিন শাসক গোষ্ঠি। এরপর একদলীয় শাসন ও রক্ষীবাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিবাদ শুরু করলে তখন জাসদসহ বিরোধী দলের অন্যান্য নেতাকর্মীদের দিয়ে তারা জেলখানা ভরে ফেলেন। পরে ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর জাসদের রাজনৈতিক ধারাও পাল্টে যায়। 

মুজিব বলেন, আমি কথাগুলো এ কারণেই স্পষ্টভাবে বলতে পারছি কারণ আমি কোন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করিনি। আমিও কিছুদিন সরকারি চাকরি করেছি। পরে গত ২৮ বছর যাবৎআমি আইন পেশায় নিয়োজিত আছি। আমার কোন ভাতার প্রয়োজন নেই, যে পরিমাণ ভাতা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া হয় সে পরিমাণ আমি নিজেই এখন আয় করতে পারি।

তিনি বলেন, ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ যশপুর রিফিউজি কলোনির একজন ভিক্ষুকের সন্তান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করেন। তার মা তখন গ্রামে গ্রামে ঘুরে ভিক্ষা করে জীবনযাপন করতেন। তিনি মানুষের বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশুনা করতেন, পড়াশুনায়ও ছিলেন খুব ভালো। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণীতে ফাস্টবয় ছিলেন। দারিদ্রের কষাঘাতে দিনাতিপাত করলেও শত চেষ্টার পরও তিনি ভাতা নিতে পারেননি। ২০২৩-২৪ সালে এসে সম্ভবত শেষ পর্যন্ত তিনি মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হতে পেরেছেন।

তখনকার ছাগলনাইয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মাওলানা ওয়ায়েজ উদ্দিন। এছাড়াও তিনি ফেনী কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন শহীদ। এখন পর্যন্ত তার পরিবার কোন সুযোগ-সুবিধা কিংবা ভাতার আওতায় আসেননি। তাহলে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা ভোগ করেছেন কারা, নিশ্চয়ই যারা তৎকালিন শাসক গোষ্ঠির অন্যায় কার্যক্রমকে সমর্থন করেছিলেন তাদেরকেই চিহ্নিত করে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে বলে দাবি মুজিবুল হকের। তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনেকেই ভুয়া। এ কারণেই স্বাধীনতার পর থেকে কোন সরকারের অন্যায় কার্যক্রমের প্রতিবাদ মুক্তিযোদ্ধারা করতে পারেননি। 

মুজিবুল হক জানান, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল থেকে দেয়া সার্টিফিকেট আমার কাছে এখনও আছে। কিন্তু তালিকর ভেতর আমার নাম নেই। চাকরির জন্য যদি আমাকে তালিকাভুক্ত হতে হয় তখন সেই তালিকাভুক্তির প্রয়োজন বোধ করিনি। ১৯৭৯ সালে আমি সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছি। পরবর্তীতে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধের মাধ্যমেই ১৯৭১ সালে অংশগ্রহণ করি মহান মুক্তিযুদ্ধে।

বিভি/এজেড

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2