গুগলের ডিস্টিংগুইশড ইঞ্জিনিয়ার জাহিদ সবুরের আত্মকথা

আপনারা অনেকেই হয়তো আমার - “পারবে না” শোনার দেশের, থেমে না যাবার গল্প - সেই ভিডিওটা দেখেছেন। ভিডিওটার ভিউ এখন ৮৩ লক্ষ পেরিয়েছে দেখলাম। আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থার হাজারো প্রতিকূলতার কাছে হার না মেনে, জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কতটা যুদ্ধ করে করে এগিয়ে যেতে হয়েছে, সেখানে তার অনেকটাই তুলে ধরেছিলাম। আমি যদিও মোটিভেশনাল স্পিকার নই কিন্তু সেই গল্পের কারণে অনুপ্রাণিত হয়ে অগণিত মানুষ আমাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন, আর প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ আমাকে ফেইসবুকে ফলো করেছেন।
সেই অভিজ্ঞতা থেকেই আমি উপলব্ধি করি যে আসলে নিজে করে দেখানোর চেয়ে বড় মোটিভেশন হয়তো আর কিছুই হতে পারে না। একই সাথে আবার সেই অগণিত মানুষের ভালোবাসাই উল্টো আমাকেই মোটিভেশন যোগায় আরও এগিয়ে যেতে। সেই সব কিছুর বিনিময়েই হয়তো আজকে আপনাদের সাথে এমন একটা সুখবর শেয়ার করতে পারছি যেটার মূল্য বা মর্ম আমি নিজেও হয়তো এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। আশাকরি সামনের দিনগুলোতে এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত আপনাদের সাথে শেয়ার করতে পারব।
আপনারা অনেকেই হয়তো জানেন যে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে আমিই সর্বপ্রথম সরাসরি গুগলে যোগ দিয়েছিলাম সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে, সেটা ছিল লেভেল ৩ পদে। তারপর একে একে ৫টা লেভেল পার করে ২০১৯ সালে আমি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে গুগলে প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ার পদে পদোন্নতি পাই। যেটা লেভেল ৮ এবং একই সাথে পরিচালকের পদ। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে গুগলে সর্বমোট কর্মীর সংখ্যা এখন দেড় লাখের উপড়ে। আর শুধুমাত্র ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যাই লক্ষাধিক।
আমি সবসময় বলি যে জীবনে context অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন মানুষের অর্জনের সার্থকতা বা মর্ম বুঝতে হলে সে কি পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে কতটা প্রতিকূলতা পেরিয়ে সেটা অর্জন করেছে সেটা বোঝা খুবই জরুরি। যে বাংলাদেশে আজও বিশ্বের টপ ৫০০ র্যাঙ্কিং এর মধ্যে কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই বলে কত না আক্ষেপ, সেই বাংলাদেশেরই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে কেউ কখনো গুগলে প্রিন্সিপাল ইঞ্জিনিয়ারের মতো উচ্চপর্যায়ে যেতে পারবে এমনটা আশা করলেও যে মানুষ পাগল ভাবতো এমনটাই আমাদের সমাজের বাস্তবতা।
স্বাভাবিক ভাবেই সেই সমাজে বেড়ে উঠে এমনটা অর্জনের স্বপ্ন দেখার অবকাশ পর্যন্ত ছিল না আমার। তারপরও বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে যখন সেখানে পৌঁছেও যাই, তখনও কিন্তু স্বপ্নেও ভাবিনি যে এরও উপড়ে যাওয়া সম্ভব। কারণ এর উপড়ের পদের নাম Distinguished Engineer অর্থাৎ একদম আক্ষরিক অর্থেই এই পদের নাম "বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার"। যেটা লেভেল ৯ এবং একই সাথে গুগলের ঊর্ধ্বতন পরিচালকের পদ।
গুগলের লক্ষাধিক ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে যোগ দিতে পেরেছে সেই সংখ্যাই যেখানে এখনও মাত্র কয়েকশো হবে, সেখানে তেমনই এক বাংলাদেশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি সম্বল করে কেউ আবার পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান গুগলের "বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার" হবে - এ আবার কেমন গাঁজাখুরি স্বপ্ন? ... কিন্তু জীবনটাই এমন যে বাস্তবতা আসলেই কখনো কখনো স্বপ্নের চেয়েও অদ্ভুত হয়!
গুগলের লক্ষাধিক ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যে Distinguished Engineer, অর্থাৎ "বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার", রয়েছেন মাত্র শখানেক, আর এখন সেই দুর্লভ সন্মান আর স্বীকৃতির খাতায় যোগ হয়েছে একজন বাংলাদেশি। কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি আমার আজকের এই পোস্টটা করার সৌভাগ্য হবে। বহু পরিশ্রম করতে হয়েছে, জয় করতে হয়েছে বহু বাধা আর প্রতিকূলতা। সৃষ্টিকর্তা, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী - সবার প্রতি জানাই অসংখ্য কৃতজ্ঞতা আর ভালোবাসা।
পরিশেষে ছোট্ট একটা অনুরোধ রইল, দয়া করে কেউ যেন এই অর্জনকে না বুঝেই অন্য কোন কিছুর সাথে তুলনা করবেন না, বা আমার আরও কি অর্জন করতে হবে সেটা যেন বলবেন না। আমাদের সমাজে সন্তুষ্টি এবং পরিতৃপ্তির বড়ই অভাব। আমাদের চাওয়া পাওয়ার যেন কোন শেষ নেই। এমন বদভ্যাসগুলো ত্যাগ করতে হবে। যেখান থেকে জীবন শুরু করে আজ আমি যেখানে এসে পৌঁছেছি, আলহামদুলিল্লাহ, এরপরেও যদি এতটা অর্জন আমার এই এক জীবনের জন্যে যথেষ্ট না হয় তাহলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাও নিশ্চয় নারাজ হবেন।
আমি নাহয় বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারদের সর্বোচ্চ অর্জনের ইতিহাসটা "গুগলের বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার" হওয়া পর্যন্ত এগিয়ে রেখে গেলাম। আশাকরি আমাদের আজকের প্রজন্মের লাখো কৃতি ছাত্র ছাত্রীদের কেউ একজন একদিন সেটাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অন্তত সেই স্বপ্নটা দেখায় তো আজ আর কারো কোন বাধা বা অনুপ্রেরণার অভাব থাকার কথা নয়, আর এটাই হয়তো আমার কাছে আমার এই অর্জনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা।
লেখক : ডিস্টিংগুইশড ইঞ্জিনিয়ার, গুগল
মন্তব্য করুন: