• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

ব্যাক বেঞ্চার কাজী আনোয়ার হোসেন

শায়ের খান

প্রকাশিত: ১৫:৫৪, ২১ জানুয়ারি ২০২৩

ফন্ট সাইজ
ব্যাক বেঞ্চার কাজী আনোয়ার হোসেন

আমাকে মাসুদ রানার পিতা কাজী আনোয়ার হোসেন বললেন, ' এখন থেকে তুমি রেগুলার লিখবে ।' আমি আকাশে উড়লাম । কাজী আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা বা কুয়াশা পড়েনি , ১৯৮০-৯০ দশকের এমন  কিশোর বা তরুণ পাওয়া যাবেনা । কাজী সাহেব ছিলেন পাঠক বানানোর কারিগর । শিক্ষক থেকে মুদির দোকানি সবার হাতে থাকতো সেবা প্রকাশনীর বই । দুর্ধর্ষ মাস্তানও কোমরে পিস্তল গুঁজে গাছের নিচে বসে সেবা প্রকাশনীর বই পড়েছে । সেবা বলতে অনেকে মনে করেন সেবা বা সার্ভিস । আসলে তা না । সেগুন বাগিচা প্রকাশনীর সংক্ষেপ সেবা প্রকাশনী । কাজী আনোয়ার হোসেন এর মালিক । সেগুন বাগিচার নিজ পৈতৃক বাসার একতলা দোতলা মিলে অফিস ও ছাপাখানা । উপরে নিজে থাকেন । পুরোনো দালানে খোদাই করে লেখা ' কাজী মোতাহার হোসেন '। 

 

সেবা প্রকাশনীর মাসিক রহস্য পত্রিকা এতো জনপ্রিয় ছিলো যে শিক্ষিত সব পরিবারেই সেটা রাখা হতো । অনেকে আশ্চর্য হবেন শুনে , এই মাসিক পত্রিকার সার্কুলেশন ছিলো প্রায় ২৫ হাজারের মতো যা এখন অনেক দৈনিক পত্রিকার নেই । এই পত্রিকায় একজন সিনিয়র সুপরিচিত লেখক ( নাম উহ্য রাখছি ) নিয়মিত রম্য রচনা লিখতেন । আমার ভালো লাগতো না । ভাবলাম , এটা যদি রম্য হয় , আমি লিখি না কেনো ? জীবনের প্রথম গল্প লিখলাম । হাসির গল্প । নাম - টেম্পো রি রি । লেখা কিভাবে জমা দিতে হয় জানিনা। নিউমার্কেট পোষ্ট অফিস থেকে রেজিস্ট্রি করে পাঠালাম । তাজ্জব ব্যাপার । পরের সংখ্যায় প্রচ্ছদে দেখি আমার গল্পের নাম ঝকঝক করছে ।  ৪০ বারের বেশি পড়লাম ছাপার অক্ষরে নিজের নাম আর গল্প । উত্তেজনায় লিখে পাঠালাম আরেক গল্প । ছাপা হলো। আবার পাঠালাম, আবার ছাপলো । সেবা অফিসে ফোন করে জানতে চাইলাম লেখা সরাসরি হাতে হাতে দেয়া যাবে কিনা । ওই প্রান্ত থেকে বললো , ' আরে, আপনাকে তো খুঁজছেন সম্পাদক । আজ সন্ধ্যায় অফিসে আসুন । ' সন্ধ্যায় গেলাম অফিসে । নিচতলায় রহস্য পত্রিকার তিন সহকারী সম্পাদক রকিব হাসান, শেখ আব্দুল হাকিম ও নিয়াজ মোরশেদ কাজ করছেন । শিল্পী ধ্রুব এষ কাগজ কেটে প্রচ্ছদ বানাচ্ছে । আমার সাইন নিয়ে ৩ গল্পের জন্য ৯০০ টাকা দিলেন অ্যাকাউন্টেন্ট । অবাক হলাম । গল্প লিখে টাকা পাওয়া যায় ? এতো ? তখন ২০০ টাকায় তিন বন্ধু মিলে ভরপুর চায়নিজ খাওয়া যায় । অ্যাকাউন্টেন্ট সাহেব বললেন, 'আপনার জন্য উনি অপেক্ষা করছেন । ওই সিঁড়ি দিয়ে উঠে যান । 'আমি এর আগে কখনো উনাকে সামনা সামনি দেখিনি । একা উঠে গেলাম । ঢুকলাম । এক অদ্ভুত সাউন্ড প্রুফ রুম । চারিদিকে শুধু অ্যাকুরিয়ামের বুদবুদ শব্দ । সালাম দিলাম । উনি আমাকে দেখে খুশি হলেন । বসতে বললেন । জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় কোথায় লিখেছি বা লিখি । বললাম, এটাই আমার জীবনের প্রথম লেখা । চট করে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালেন । অবচেতন ভাবে ড্রয়ার থেকে লাইসেন্স করা পিস্তলটা বের করে টেবিলে রাখলেন । বললেন, বাসায় আর কে কে লিখে ? বললাম, কেউ না । পিস্তলটা উনি আরো কাছে টেনে নিলেন সতর্কতার সাথে । বললেন, 'এখন থেকে রহস্য পত্রিকার রম্য বিভাগটা তোমার । তুমি রেগুলার লিখবে । 'আমি মনে মনে আকাশে উড়তে লাগলাম । আমার বয়স তখন ২১ বছর ৪ মাস । দেশের সেরা ম্যাগাজিনের রম্য লেখক হতে যাচ্ছি আমি । প্যাটিস, পেস্ট্রি, কোক এলো । কিছু আলাপ আলোচনা করে বিদায় নিলাম । 

কাজী আনোয়ার হোসেন এরপরে এক বইমেলায় আমার রম্যের বই বের করে দেন । হ্যান্ডসাম অ্যামাউন্টের টাকা দেন রয়্যালটি হিসেবে । সেই বইমেলার একটা ঘটনা বলে শেষ করি । সেবা অফিস থেকে উনার সাদা টয়োটা পাবলিকায় দুজন গেলাম বইমেলায় । মেলায় সেবা প্রকাশনীর স্টলের সামনের ঘাসে চেয়ারে বসে আমরা দুজন গল্প করছি । দুজন কলেজ গার্লকে স্টল থেকে আমাদের দেখিয়ে বলা হয়েছে , লেখক ওখানে । লেখকের অটোগ্রাফ চাচ্ছে ওরা । আমাদের সামনে এসে কাজী'দাকে বইটা মেলে ধরে বলে ,' অটোগ্রাফ প্লিজ । ' বইটা আমার সদ্য বেরুনো বই ' রসগল্প । ' কাজী'দা মজা পেলেন । হেসে  বললেন , 'এটা আমার বই না । লেখককে চিনো ? এই যে লেখক এখানেই । 'ওরা হতাশ হলো । আমাকে ওদের লেখক মনে হয়নি । সম্ভবত কলেজের সামনের শিস দেয়া টাংকিবাজ মনে হয়েছে । লেখক মানেই  বাবার বয়সী গম্ভীর কেউ হবে । অনিচ্ছা সত্ত্বেও বই এগিয়ে দেয় । আমি লিখি, আপনারা দুজনই কিউট । পড়ে ওরা চোখাচোখি করে হেসে দেয় । আমি যে কলেজের শিসওয়ালা টাংকিবাজ, পূরোপুরি কনফার্ম হয় । 

কাজী আনোয়ার হোসেনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সৈয়দ শামসুল হক সম্পর্কে । বলেছিলেন, 'ও আর আমি দুজন ক্লাসমেট ও বাল্যবন্ধু । দুজনই ব্যাক বেঞ্চার ছিলাম । কিন্তু ও আমার একটি বইও জীবনে পড়েনি, আমিও ওর কোনো বই জীবনে পড়িনি । ' প্রিয় কাজী আনোয়ার হোসেন, আমি দেখেছি কি বিশাল হৃদয়ের মানুষ আপনি । আপনি ছিলেন নির্লোভ, নিরহঙ্কার, অভিজাত, স্মার্ট, ক্রিয়েটিভ । কাজী মোতাহার হোসেনের ছেলে তো রাজপুত্রই হবে । শুনেছি আপনার মৃত্যুর আগে মন:কষ্টের কথা । আমি আশ্চর্য হইনি । রাজা বাদশাহদের অসতর্ক উদারতাই অকৃতজ্ঞ প্রাসাদকর্মীদের শক্তি । আমি নিজেও পথ থেকে নিজ হাতে তুলে এনে সাইজ করা চাকর বাকরের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি । আপনি শান্তিতে ঘুমান । ঠিক সময়ে সব কালো রঙ সাদা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আপনাকে বেহেস্ত নসীব করুন । 

লেখক - নাট্যকার - ফিল্ম মেকার
 

মন্তব্য করুন: