• NEWS PORTAL

  • শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪

রক্তিম হৃদয়ের বার্টার

মারুফ কামাল খান

প্রকাশিত: ১৮:০১, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

আপডেট: ১৮:০৩, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

ফন্ট সাইজ
রক্তিম হৃদয়ের বার্টার

সমুদ্র গুপ্ত ও গুন্টার গ্রাস (ডানে)

স্মৃতি বড়ই বিচিত্র। জীবনের কতো বড় বড় ঘটনা বিস্মৃতির অতলে হারায়। আবার খুব ছোট ছোট কিছু ঘটনা দারুণভাবে মনে দাগ কেটে বসে থাকে; ভোলা যায়-না কিছুতেই। বাংলা একাডেমীর অমর একুশে গ্রন্থমেলা নিয়ে কিছু স্মৃতিকথা লিখার পর থেকেই ক্ষুদ্র একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছে। লিখবার সময় কেন এটা মনে আসলো-না, কেন এটা পরে মনে পড়লো তা' নিয়ে ভেতরে খুব খোঁচাচ্ছে। অথচ ঘটনাটা খুবই সামান্য।

 

বইমেলায় হাঁটছিলাম। বগলে উপহার হিসেবে পাওয়া একগাদা বই। হঠাৎ পরিচিত কণ্ঠে ডাক : "এই যে সাংবাদিক সা'ব! এতো বোঝা বয়ে পথ চলা যায়?" তাকিয়ে দেখলাম পুকুরপাড়ে দু'-তিন জনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দা। কবি-সাংবাদিক সমুদ্র গুপ্ত। কাছে যেতেই বইগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন : "আসেন, আপনার ভার কিছুটা লাঘব করে দেই।" তারপর বিখ্যাত গোঁফ নাচিয়ে সে কী হাসি! আমার হাতের বইগুলো দেখে বললেন : "বেশিরভাগই তো দেখি অখাদ্য। কাগজ-কালির কী নিদারুণ অপচয়। এ-সব গার্বেজ বয়ে বেড়াচ্ছেন কেন? ফেলে দেন, নয়তো ওই ঝাল-মুড়িঅলাকে দেন, ওর কিছুটা কাজে লাগবে।

বললাম : "ফেলে দিলে যারা বই দিয়েছেন তাদের মন খারাপ হবে।" সমুদ্র দা বললেন : "তা' ঠিক।" তারপর বইগুলো থেকে বেছে বিভিন্ন গল্পকারের ছোটগল্পের একটা সংকলন হাতে নিয়ে বললেন : "আচ্ছা আমি নেই এটা। পড়ে দেখা যাবে।" আমি সম্মতি দিলে সমুদ্র দা বললেন : "কিন্তু কোনো একটার বিনিময়ে তো নিতে হবে।" পাশের স্টল থেকে তাঁর সদ্য প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'এখনো উত্থান আছে'-এর একটি কপি আনালেন। তাতে লিখলেন : "বিনিময় কখনো ভালো/ কখনো বা নয়/ বার্টার সিস্টেমে এসো/ বিনিময় করে ফেলি/ আমাদের রক্তিম হৃদয়।" তার নিচে স্বাক্ষর করে বইটি তুলে দিলেন আমার হাতে। বললেন : "আমার পরামর্শ মোতাবেক আবর্জনা ভেবে এটা আবার ফেলে দিয়েন-না যেন।"
তারপর আবারো হাসি। 

সমুদ্র দা'র সে বইটা ফেলে দেয়ার প্রশ্নই আসে-না। কিন্তু সেটা হারিয়ে ফেলেছি নাকি কোথাও রয়ে গেছে তা' নিশ্চিত করে বলতে পারছি-না। তবে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ছোট্ট যে কবিতাটি লিখে বইটি আমাকে উপহার দিয়েছিলেন সেটা মুখস্তই আছে। সমুদ্র গুপ্তের আসল নাম ছিল আবদুল মান্নান। ডাক নাম বাদশা। কিন্তু দুটো নামই হারিয়ে গিয়েছিল তার সাহিত্যিক ছদ্মনাম সমুদ্র গুপ্তের আড়ালে। সমাজ বদলের বামপন্থী বিপ্লবী রাজনীতি করতেন তিনি। পরে প্রত্যক্ষ রাজনীতি ছেড়ে লেখালেখিকেই ব্রত হিসেবে বেছে নেন।
অধুনালুপ্ত দৈনিক দেশ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি বার্তা বিভাগে যুক্ত হন। আমরা দৈনিক দেশ-এ যোগ দেয়ার আগের ঘটনা সেটা। কিন্তু এরশাদ আমলে নিষিদ্ধ হবার পর দ্বিতীয় দফায় দৈনিক দেশ প্রকাশের সময় সমুদ্র দা'র আর সেখানে চাকরি হয়-নি আরো অনেকের সঙ্গে। এরপর থেকে তিনি লেখালেখির পাশাপাশি এনজিওতে টুকটাক কাজ করে খুব কায়ক্লেশে সংসার চালাতেন। তবুও এতোটুকু ম্লান হয়নি তার প্রাণোচ্ছলতা। সাহস ও সংগ্রাম তার জারি ছিল। সেই বিখ্যাত হাসি, কবিতা ও দারুণ রসবোধ থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হননি তিনি।

জার্মানির নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিক গুন্টার গ্রাস বাংলাদেশে এসেছেন। প্রথমবার নোবেল পাবার আগে ১৯৮৬ সালে এবং দ্বিতীয়বার নোবেল পাবার পর সম্ভবতঃ ২০০১ সালে। আমি বলছি দ্বিতীয়বারের কথা। একটা অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করবেন তিনি। ভেন্যুটা ঠিক কোথায় ছিল এখন মনে করতে পারছি না। যা-হোক, আমি গেলাম বক্তৃতা শুনতে। অতিথি আসার সময় তখনো হয়নি। শ্রোতারা দু'-চার জন করে আসছিলেন। ঢুকে দেখি প্রথম সারিতে সমুদ্র দা বসা।
আমাকে দেখেই ডাকলেন। পাশের চেয়ারে বসতে বললেন। কিন্তু চেয়ারটার ওপর একটা বলপয়েন্ট কলম রাখা। আমি সেদিকে তাকাতেই পরের চেয়ারে বসা এক তরুণ বললো : "সিটটা আমি রেখেছি একজনের জন্য।" সমুদ্র দা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন : "খবরদার ও সিটে বসবেন না। ওটা সংরক্ষিত মিসেস গুন্টার গ্রাসের জন্য।" এ কথা শুনেই ছেলেটি কলমটা তুলে পকেটে গুঁজে দু'সারি পেছনে চলে গেলো। সমুদ্র দা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন : "বসুন এখন।"

ঘটনা তখন অনেক বাকি। মঞ্চে ছিল গুন্টার গ্রাসের ছবি। আর সমুদ্র দা'র পরের চেয়ারেই বসেছিলেন মাঝবয়েসী মোটাসোটা এক ভদ্রমহিলা। সম্ভবতঃ তার পরিচিত। তিনি ক্রমাগত কথা বলছিলেন। এবং অদম্য তার কৌতূহল। সমুদ্র দা'র সঙ্গে গুন্টার গ্রাসের গোঁফের সাযুজ্য দেখে কিনা জানিনা, ভদ্রমহিলা তাকে বললেন : "গুন্টার গ্রাসের সঙ্গে আপনার চেহারার বেশ মিল আছে।"
সমুদ্র দা গম্ভীর কন্ঠে বললেন : "একই ফ্যামিলির দু'জন লোকের চেহারায় মিল তো থাকারই কথা।" ভদ্রমহিলা আরও কৌতূহলী হয়ে বললেন : "একই ফ্যামিলি মানে কি? আপনারা দু'জনেই সাহিত্যিক, সেটা কি এক ফ্যামিলি হলো?"
সমুদ্র দা এবার একটা মস্ত গল্প ফাঁদলেন। বললেন : "সেটা নয়। আসল খবরই তো জানেন না। গুন্টার গ্রাসের বাবা আমার দাদার ভাইয়ের ছেলে। উনি কোলকাতায় পড়তেন ব্রিটিশ পিরিয়ডে। তরুণ বয়সেই ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। তারপর নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর সঙ্গে জার্মানিতে যান। তিনি সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়লে সুভাষ বোসের সঙ্গে সাবমেরিনে চড়ে জাপানের উদ্দেশে রওনা দিতে পারেন নি। পরে নেতাজী অন্তর্ধান হলে আমার চাচা বিয়েশাদি করে জার্মানিতেই স্থায়ী হয়ে যান। তার ছেলে গুন্টার গ্রাস আমার চাচাতো ভাই।"

ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন : "বাঙালির ছেলের নাম গুন্টার গ্রাস হলো কেন?" সমুদ্র দা একটুও না ভেবেই বললেন : ছোটবেলা থেকেই উনি একটু গুন্ডা প্রকৃতির ছিলেন। আবার কম বয়স থেকেই লম্বা গোঁফ রাখেন। সে কারণে তার বাবা ঘাসের মতন গোঁফ রাখা গুন্ডা ছেলেকে রাগ করে গুন্ডার ঘাস বলে ডাকতেন। সেটাই জার্মান উচ্চারণে হয়ে গেছে 'গুন্টার গ্রাস।'
ভদ্রমহিলা হয়তো কিছুটা বিশ্বাসই করছিলেন। কিন্তু এটুকু বলেই সমুদ্র দা আর হাসি চেপে রাখতে পারেন না। এটাই একটা সমস্যা ছিল তাকে নিয়ে। খুব গম্ভীর ভাবে বলা তার এ-সব কথা যখন লোকে প্রায় বিশ্বাস করে ফেলতো, ঠিক তখনই তিনি হেসে ফেলতেন। তাতে সবাই বুঝে ফেলতো এতোক্ষণ তিনি যা বলেছেন তার সবটাই ফান।

এর মধ্যে অতিথি এসে গেলেন। তার আগেই মিলনায়তন কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল। গুন্টার গ্রাস খুব রাশভারি মানুষ ছিলেন। খুব সিরিয়াস কথাবার্তা বলতেন। তাঁর বক্তৃতা ছিল খুব উঁচু মার্গের। সেবার তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের কিছু প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারীদের দুর্দশা নিয়ে মর্মস্পর্শী কিছু কথাও বলেছিলেন। তাদের নিয়ে একটা বই লেখার পরিকল্পনার কথাও জানিয়েছিলেন। জীবদ্দশায় সে বই তিনি লিখে যেতে পেরেছিলেন কিনা তা' আর জানা হয়নি।

লেখক : সাংবাদিক ও লেখক

মন্তব্য করুন: