• NEWS PORTAL

  • মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

হারিয়ে ফেলা দুই রত্ন

প্রকাশিত: ১২:২২, ৪ মে ২০২৩

আপডেট: ১২:২৯, ৪ মে ২০২৩

ফন্ট সাইজ
হারিয়ে ফেলা দুই রত্ন

ডা.  জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ফজলে হাসান আবেদ

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞ যখন চলছিল, ঠিক সেই সময় ইংল্যান্ডে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর এফআরসিএস ফাইনাল পরীক্ষার আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। তিনি দেশের টানে স্বপ্নের সেই পরীক্ষা বাদ দিয়েই দেশে ছুটে এসে মুক্তিযুদ্ধে হতাহতদের চিকিৎসাসেবা দিতে শুরু করলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতে গড়ে তোলালেন ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট দেশের প্রথম ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ হাসপাতাল। এফআরসিএস ফাইনাল পরিক্ষা অসমাপ্ত রেখে দেশে ফেরার পূর্বে ইংল্যান্ড কী কাহিনি ঘটিয়েছিল, জানেন তো? 
পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতার প্রতিবাদে লন্ডনের হাইড পার্কে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বাঙালি পাসপোর্ট ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে বৃটিশ সরকার এর স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে 'রাষ্ট্রবিহীন নাগরিক' প্রত্যায়ন পত্র সংগ্রহ করে ভারতীয় ভিসায় দেশে ফিরতে হলো।


মুক্তিযুদ্ধের ২ নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ ও  ভারতের জিবি হাসপাতালের প্রধান সার্জন ডা. রথিন দত্তের সহযোগিতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদের প্রথম জিএস ডা. এমএ মবিনকে নিয়ে তিনি সেই স্বল্প সময়ের মধ্যে অনেক নারীকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য জ্ঞান দান করেন যা দিয়ে তারা রোগীদের সেবা করতেন এবং তার এই অভূতপূর্ব সেবাপদ্ধতি পরে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল পেপার ‘ল্যানসেট’-এ প্রকাশিত হয়। হাসপাতালটির কমান্ডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ডা. সিতারা বেগম বীরপ্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের সময় অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠা করা ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটি। দেশ স্বাধীনের পর মুক্তিযুদ্ধে অস্থায়ীভাবে গঠিত ফিল্ড হাসপাতালটির নাম পরিবর্তন করে ‘গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র হাসাপাতাল’ নামে নতুন করে গড়ে তোলা হয় কুমিল্লায়। পরবর্তীতে সেটা ঢাকার সাভারে স্থানান্তর করে ‘নগর গণস্বাস্থ্যকেন্দ্র হাসাপাতাল’ রাখা হয়। 


যুক্তরাষ্ট্রের মূল পেডিয়াটিক্স টেক্সট বইয়ের একটা চ্যাপ্টার ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী লিখতেন বেশ কয়েক বছর ধরে। তার লেখা বইয়ের সংখ্যা অনেক। দেশে-বিদেশে প্রচুর জার্নালে তার অসংখ্য পেপার প্রকাশিত হয়েছে। প্রাইমারি কেয়ার নিয়ে লেখা তার সম্পাদিত ও প্রকাশিত একটি বই ‘যেখানে ডাক্তার নেই’—একসময় অবশ্য পাঠ্য ছিল বাংলাদেশের ঘরে ঘরে। ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়ন ছিলো তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। যে ওষুধ নীতির কারণে আজকে কমদামে ওষুধ পাচ্ছে গরিবদুঃখীরা। ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলেই নিজেদের মন মতো ওষুধের দাম নির্ধারণ করতে পারছে না। বর্তমানে ৯০ শতাংশ ওষুধই দেশে তৈরি হচ্ছে এবং বাংলাদেশ পরিণত হয়েছে একটি ওষুধ রপ্তানিকারক দেশে। অথচ জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকায় ১৯৯২ সালে তার সদস্যপদ বাতিল করেছিল বিএমএ। বিনা বিচারে তার ফাঁসি চেয়ে পোস্টারও সাঁটিয়েছিল তখনকার সময়।


সত্তরের দশকে ব্যক্তিগত কারে চড়তেন তিনি, অথচ সেই মানুষটি গত ২০ বছর ধরে জোড়াতালি দেয়া একটা নর্মাল সাদা পায়জামা, দুইটা শার্ট পরে জীবন কাটিয়েছেন। একবার সাংবাদিক তাকে প্রশ্ন করেছিল, পাকিস্তান আমলে আপনি ব্যক্তিগত গাড়িতে চড়তেন, উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান আপনি, অথচ আপনার প্যান্ট ছেঁড়া। জবাবে তিনি বলেছিলেন, এই প্যান্ট পুরোপুরি নষ্ট হয় নাই, আমি এটি ফেলে দিব কেন! আমি ২০ বছর ধরে পরে আসছি এই শার্ট-প্যান্ট। এই মানুষটি চাইলে হতে পারতেন বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের একজন। অথচ তিনি বেঁচে নিলেন সহজ সরল জীবনযাপন; সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের পথ। সাধারণ মানুষকে কমদামে ওষুধ সরবরাহ করতে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে মাত্র ১২০০ টাকায় ডায়ালাইসিস করতে পারেন দরিদ্র মানুষ। মৃত্যু পূর্বে তাকে বহুবার বলা হয়েছিল, ভালো চিকিৎসার জন্য বিদেশে স্থানান্তর করার কথা। কিন্তু তিনি বারবার জোর গলায় নিষেধ করলেন, আমি এখানেই চিকিৎসা নিব। নিজের হাসপাতালে যদি নিজে চিকিৎসা না নিই, তাহলে মানুষ কিভাবে আসবে।

স্যার ফজলে হাসান আবেদ
২০০২ সালে জাতিসংঘের উন্নয়ন সংস্থার তৎকালীন প্রধান আফগানিস্তানে ভয়াবহ যুদ্ধের মধ্যে তাদের কমিউনিটি স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত পৃথিবীর সব দেশের প্রতিনিধিদের অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তখন অডিটোরিয়াম ভর্তি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের কেউ সাড়া দেননি। সবাই চুপচাপ বসেছিল। এমন সময় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা উপস্থিত স্যার ফজলে হাসান আবেদ হাত তুলে বললেন, ‘আমি যেতে পারবো সেখানে; কেউ না থাকলেও আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য ক্লিনিকগুলোর দায়িত্ব আমি নিবো।’ 


১৯৭১সালে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিখ্যাত অয়েল কোম্পানির উচ্চপদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে লন্ডনে চলে যান। সেখানে গিয়ে বন্ধুদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক সহয়তার জন্য গড়ে তুললেন ‘হেলপ বাংলাদেশ’ ও ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ—  নামে দুটি সংগঠন। অ্যাকশন বাংলাদেশ-এর কাজ ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক সমর্থন আদায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষে জনমত তৈরি এবং পাকিস্তানি বাহিনির বর্বরোচিত কার্যকলাপ বন্ধের জন্য ইউরোপীয় দেশসমূহের সরকারকে সক্রিয় করে তোলা। অপরদিকে ‘হেলপ বাংলাদেশ’-এর কাজ ছিলো মুক্তিবাহিনীকে অর্থ সহয়তা করতে অর্থসংগ্রহ করা সাথে বাংলাদেশের স্বপক্ষে প্রচারণাপত্র বিলি করা, টাইমস অব লন্ডনে লেখা ও বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা, রেডিও ও টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দেওয়া, ইউরোপীয় দেশসমূহের পার্লামেন্ট সদস্যদের আলোচনার মাধ্যমে স্বদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিবিধ কর্মতৎপরতা পরিচালনা করা। 


একটি ইমোশনাল তথ্য হলো- ১৯৭২ সালে যখন তিনি দেশে ফিরছিলেন তখন লন্ডনে তার স্বপ্নের বাড়িটা বিক্রি করে দিয়েছিলে। এ বাড়ি বিক্রির পুরো অর্থ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আপনি ভাবতে পারেন, দেশের মানুষের প্রতি কী পরিমাণ ভালোবাসা থাকলে এমনটা সম্ভব!
যুদ্ধ পরবর্তী বিধ্বস্ত অবস্থায় দেশে এসেছে সিলেটে নিজ অঞ্চলে দারিদ্র্য বিমোচন ত্রাণ বিতরণ শুরু করলেন তিনি নিজেই। ভাবলেন বছরখানেক বাদে আবার বিদেশে গিয়ে চাকরিতে যোগ দিবেন, কিন্তু কাজ করতে গিয়ে যে দারিদ্র্যতা তিনি দেখলেন, এতো দরিদ্র মানুষকে এভাবে ফেলে রেখে বিদেশে চাকরি করে আরাম-আয়েশে থাকাটা তিনি কখনো ভাবতে পারেননি। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেম, সারা জীবন দারিদ্র্য বিমোচনের কাজে নিয়োজিত থাকবেন। গড়ে তুলেছেন বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ব্র্যাক’কে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলেছেন। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লাখ লাখ মানুষের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন এবং দারিদ্র বিমোচনে কাজ করে গেলেন স্যার ফজলে আবেদের গড়ে তোলা ব্র্যাক। বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১১টি দেশে ব্র্যাকের লক্ষাধিক কর্মী প্রায় তের কোটি মানুষের জীবনে উন্নয়নে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ভুমিকা রেখেছে। তার নেতৃত্বে ব্র্যাক যক্ষা, ম্যালেরিয়া দূরীকরণ লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে।
যে অল্পকজন বাংলাদেশী দেশের সুনাম বিশ্বে অনেক বৃদ্ধি করেছেন তাদের মধ্যে স্যার ফজলে হাসান আবেদ অন্যতম। তার অবদান আমরা কোনদিন ভুলবার নয়।

মন্তব্য করুন: