একজন জোবাইদা রহমান ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঐতিহ্য

ডা. জোবাইদা রহমান
প্রতিটি মানুষের জীবনে এমন কিছু গল্প থাকে যা তাকে সাধারণ থেকে অসাধারণ করে তোলে। ডা. জোবাইদা রহমানের জীবন কাহিনীও তেমনি। যেখানে ঐহিত্য, ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ দিয়ে তৈরি করেছেন এক অনুকরণীয় গল্প।
রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও তার জীবন ছিলো চ্যালেঞ্জে ভরা। কিন্তু সেসব চ্যালেঞ্জকে সাফল্যে পরিণত করেন ডা. জোবাইদা রহমান। একজন চিকিৎসক, সংগ্রামী নারী এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সহধর্মিনী হিসেবে দেখিয়েছেন কঠিন পরিস্থিতিতে মানবিকতা ও সাহসিকতার সাথে কীভাবে অটল থাকা যায়।
১৯৭২ সালের ১৮ই জুন তার জন্ম। তিনি সম্ভ্রান্ত ও প্রভাবশালী মুসলিম পরিবারের মেয়ে। তার বাবা রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী বাংলাদেশের তৃতীয় নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ ও কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
তার মা সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানু বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক। জাতীয় জীবনে অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য ১৯৯৫ সালে তাকে সমাজসেবায় ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ দেওয়া হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী জোবাইদা রহমানের আপন চাচা ছিলেন।
তার মেজো চাচা আজমল আলী খান ছিলেন অবিভক্ত পাকিস্তানের মন্ত্রী। আরেক চাচা ডা. সেকেন্দার আলী খান। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আইরিন খানের চাচাতো বোন জোবাইদা ১৯৯৫ সালে চিকিৎসকদের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন। ডা. জোবাইদা রহমান লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন থেকে মেডিসিন বিভাগে অধ্যায়ন করে রেকর্ড নম্বর ও স্বর্ণপদক নিয়ে সম্মানজনক ‘এমএসসি’ ডিগ্রি অর্জন করেন।
শুধু তাই নয়, ডা. জোবাইদা রহমানের দাদা আহমেদ আলী খান ভারতবর্ষের প্রথম মুসলিম ব্যারিস্টার। ছিলেন আসাম কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট, নিখিল ভারত আইন পরিষদ সদস্য এবং হায়দ্রাবাদ নিজামের প্রধান আইন উপদেষ্টা। তার দাদি জোবাইদা খাতুন অবিভক্ত আসাম, বিহার ও উড়িষ্যার জমিদার খান বাহাদুর ওয়াসি উদ্দিন আহমেদের মেয়ে। ডা. জোবাইদা রহমানের প্রপিতামহ ডা. খান বাহাদুর আজদার আলী খান বিহার ও আসাম মেডিকেল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা এবং পাটনা মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক ছিলেন।
ডা. জোবাইদা রহমানের ব্যক্তিগত জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো বিবাহ। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের সাথে ১৯৯৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জিয়া পরিবারের পুত্রবধূ হলেও জোবাইদা চিকিৎসা পেশা আগলে রেখেছেন। চিকিৎসকের পাশাপাশি তিনি একজন রাজনীতিবিদের স্ত্রীও। তারেক রহমান ও ডা. জোবাইদা রহমান দম্পতির একমাত্র সন্তান ব্যারিস্টার জায়মা রহমান। ছোটবেলা থেকে লন্ডনেই পড়াশোনা করেছেন তিনি। বিশ্বখ্যাত লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটি থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন ও পরবর্তীকালে লন্ডনের ঐতিহ্যবাহী লিংকনস ইন থেকে ২০১৯ সালে বার অ্যাট ল সম্পন্ন করেন।
২০০৭ সালে তারেক রহমান যখন রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার হন, তখন তিনি সাহসের সাথে পাশে দাঁড়িয়ে দক্ষতার সাথে প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেন। পরিবারের দায়িত্ব, পেশাগত চাপ ও সামাজিক দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে তিনি যে অসাধারণ দৃঢ়তা দেখিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়।
২০০৮ সালে স্বামীর জেলমুক্তির পর শিক্ষাছুটি নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান তিনি। স্বামীর চিকিৎসা শেষ না হওয়ার কারণ দেখিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার ছুটি বাড়ানোর আবেদন করেছিলেন ডা. জোবাইদা রহমান। কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় ছুটি মঞ্জুর করেনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পরবর্তীকালে দীর্ঘ অনুপস্থিতি দেখিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, যা সরকারের হীন প্রচেষ্টারই অংশ।
লন্ডনে প্রবাস জীবনে থেকেও তিনি বাংলাদেশের প্রয়োজনে সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে গণস্বাস্থ্যের উদ্ভাবিত স্বল্প মূল্যের রোগ নির্ণায়ক কিট,খাদ্য সহায়তা, ওষুধ সহায়তাসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে করোনা আক্রান্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সারাদেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সমন্বয়ে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের জন্য খণ্ড খণ্ড মেডিকেল ক্যাম্প পরিচালনায় জনস্বার্থে ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন। তিনি মরহুম মাহবুব আলী ফাউন্ডেশন এবং সুরভী নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনস্বার্থে ব্যাপক অবদান রাখছেন।
প্রখর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, মার্জিত, শ্রদ্ধেয় ডা. জোবাইদা রহমানকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অনেককেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে দেখা গেছে, যেটা ঈর্শ্বানিত হওয়ার অন্যতম কারণ। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের স্বনামধন্য দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকাও বিভিন্ন সময়ে ডা. জোবাইদা রহমানের প্রশংসায় প্রতিবেদন প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ২০০৮ সালে তৎকালীন সরকারের দায়ের করা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগের মামলায় ডা. জোবাইদা রহমানকে ৩ বছরের কারাদণ্ড ও ৩৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল। দেশের মানুষের একটি বড় অংশ মনে করেন- তার ভাবমর্যাদা নষ্ট করার জন্য পরিকল্পিতভাবে মামলা এবং সাজার রায় দেওয়া হয়েছিলো। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিচারিক আদালতের সেই সাজা স্থগিত হয়েছে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর আগামী ৬ মে শাশুড়ি সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশে ফিরছেন ডা. জোবাইদা রহমান।
এদিকে বেগম খালেদা জিয়ার সাথে তার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান সিঁথিও আসছেন। এক/এগারো সরকারের সময় স্বামী আরাফাত রহমান কোকোর সঙ্গে মালয়েশিয়া যান শর্মিলা। ২০১৫ সালে কোকোর মৃত্যুর পর দুই মেয়েকে নিয়ে লন্ডনে বসবাস শুরু করেন তিনি। খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে ২০২১ সালের অক্টোবরে তাকে দেখতে ঢাকায় আসেন শামিলা। সে সময় তিনি আড়াই মাস ঢাকায় ছিলেন। প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকো এবং শামিলা দম্পতির জাফিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমান নামে দুই মেয়ে রয়েছে।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: