কারাগার আর কোর্টই ছিলো এসএম জাহাঙ্গীরের সঙ্গী

ছবি: এস এম জাহাঙ্গীর
ফ্যাসিবাদ সরকারের বিরুদ্ধে ছিলেন আপসহীন নেতা। তাই তার জীবনে সঙ্গী হয়েছিলো কারাগার। ১২ মাসের বেশির ভাগ সময় কেটেছে হাসিনা সরকারের মিথ্যা মামলায় কারাগার আর কোর্টে। আর বাইরে থাকলেও সরকারি ছুটির দিন ছাড়া হাজিরা দিতে কোর্টের বারান্দায় কেটেছে দিন। তবুও অবিচল ছিলো জিয়ার আদর্শে।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং উপ-নির্বাচনে ঢাকা-১৮ আসনের প্রার্থী ও বর্তমানে ধানের শীষের কাণ্ডারি এস এম জাহাঙ্গীর হোসেনের বিরুদ্ধে ৩২৯টি মামলা রয়েছে। যা দলে মামলার দিক থেকে তৃতীয়।
সেই সময়ের ভয়ঙ্কর স্মৃতিচারণ করে এস এম জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা বাংলাভিশনকে জানান, ‘তখন প্রায় প্রতিটি কার্যদিবসে জাহাঙ্গীরকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার আদালতে হাজির করা হতো। প্রায় প্রতিদিন কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আনা-নেওয়ার ফলে জাহাঙ্গীরসহ অনেক নেতাই অসুস্থ হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ করেন তিনি।’
এসময় তিনি বলেন, এখন বাসায় ঘুমানোর সুযোগ হলেও তিনি ঢাকা-১৮ আসনের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৩১ দফার বার্তা পৌছে দিচ্ছেন। এখনও সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত বাইরেই থাকেন দলের কাজে। ’
এক নজরে এসএম জাহাঙ্গীরের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার:
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে,এসএম জাহাঙ্গীর ১৯৮৮ সালে তেজগাঁও কলেজে পড়ার সময় ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সামরিক সরকারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৯০ সালে তেজগাঁও কলেজ ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালে তেজগাঁও কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। ১৯৯৪ সালে ছাত্রদলের পিন্টু-নিরবের নেতৃত্বাধীন কমিটিতে সমাজকল্যাণ সম্পাদক ছিলেন। ২০০১ সালে ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি,২০১০ সালে ছাত্রদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক, ২০১০ সালে যুবদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সাধারণ সম্পাদক, পরবর্তীতে ২০১৭ সালে যুবদলের ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন এসএম জাহাঙ্গীর। এছাড়াও ছাত্রদল এবং যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিভিন্ন সময় সহ-সভাপতি, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দীর্ঘ সময় নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। রাজনীতিতে এই ত্যাগের স্বীকৃতিও মেলে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। বিএনপি ঢাকা-১৮ আসনে,পরবর্তীতে এই আসনের উপ-নির্বাচনেও পরপর দুইবার এসএম জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন দেয়।
এসএম জাহাঙ্গীরের জন্ম ঢাকাতেই। এই শহরেই লেখাপড়া। শহরের আলো-ছায়ায় বেড়ে ওঠা।১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো রাষ্ট্র ক্ষমতায়।ওই সময় ছাত্রদলের হয়ে হরতালের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে তেজগাঁও এলাকা থেকে প্রথমবারের মতো আটক হন তিনি। এক মাস কারা ভোগের পর মুক্তি পান। ওই বছরই আরও একটি হত্যা মামলায় তাকে জড়ানো হয়। প্রাণভয়ে তখন ফেরারি জীবন বেছে নিতে বাধ্য হন এসএম জাহাঙ্গীর। ২০০৭-২০০৮ সালে এক-এগারোর সময় সেনা সমর্থিত সরকারের দুই বছরও তাকে জীবন বাঁচাতে এখানে-ওখানে পালিয়ে বেড়াতে হয়। এই পালিয়ে বেড়ানো আর ফেরারি জীবন শেখ হাসিনার শাসনামলেও অব্যাহত ছিলো। একের পর এক মামলা,আটক,জামিন,আবার আটক-এভাবেই কেটে গেছে দিনের পর দিন। গুম হতে পারেন-এমন খবর পাওয়ার পর স্ত্রী, দুই সন্তানসহ পরিবারের বাকি সদস্যদের ফেলে রেখে একটি অন্ধকার ঘরে লুকিয়ে ছিলেন একটানা ছয় মাস। ২০১২ সালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে একটি মিথ্যা ও সাজানো মামলায় আটক হন এসএম জাহাঙ্গীর। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে টানা আট মাস কারাগারে ছিলেন তিনিও। ২০১৮ সালে আরেকটি সাজানো মামলায় গভীর রাতে আদালত বসিয়ে তার বিরুদ্ধে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০২৩ সালে আরেকটি মামলায় আটক হন। দেওয়া হয় আড়াই বছরের কারাদণ্ড। ওই মামলায় টানা এক বছর কারাগারে ছিলেন এসএম জাহাঙ্গীর।
ঢাকা-১৮ আসন ঘুরে স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে- শেখ হাসিনার টানা সাড়ে পনেরো বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনামলের বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে বিএনপির অনেকে গুম-খুনের শিকার হয়েছেন। একইভাবে দলটির লাখ লাখ নেতাকর্মী হামলা-মামলা-গ্রেফতারসহ নানাভাবে দমন-পীড়ন এবং নির্যাতনের শিকার হন। কোনোটি গাড়ি পোড়ানো, কোনোটি ককটেল বিস্ফোরণ,কোনোটি হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ। আবার কখনো বা সরকারি কাজে বাধা প্রদান-এ রকম হাজারো গায়েবি মামলায় আসামি ছিলেন তারা। তাদেরই একজন এসএম জাহাঙ্গীর।
স্থানীয় নেতারা বলছেন, গত বছর জুন-জুলাইয়ে শেখ হাসিনার পতনের আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন গ্রেফতার হন তিনি।২২ জুলাই ডিবি পুলিশ উত্তরা থেকে আটক করে তাকে। পরে হারুনের সেই ভয়াল টর্চার সেলে টানা ১২ দিন অন্ধকার প্রকোষ্ঠে আটক ছিলেন তিনি। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার পতন ঘটলে ৬ আগস্ট মুক্তি পান এসএম জাহাঙ্গীর।
এর আগে বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তরের যুগ্ম আহ্বায়ক এই নেতার নামে বিভিন্ন সময়ে ৩২৭টি মামলা দেয় ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার সরকার। এর মধ্যে নিম্ম আদালত তার বিরুদ্ধে একটি মামলায় সাত বছর এবং আরেকটি মামলায় আড়াই বছরের কারাদণ্ড দেয়। বর্তমানে এসব মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। পাঁচ আগস্ট পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছু মামলা আইনি প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি হলেও এখনো তিন শতাধিক মামলা রয়ে গেছে এসএম জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বিএনপি নেতাদের দাবি-দল যখন চাপে ছিল,তখন এস এম জাহাঙ্গীর ভাই আমাদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন। রাজধানীর প্রবেশপথ গুরুত্বপূর্ণ এ আসনে অন্য কেউ যদি প্রার্থী হন,নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
তারা বলছেন, ৫ আগস্টের পর তিনি জেল থেকে ছাড়া পায়। জেল থেকে বের হয়ে এসেই কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে নিয়ে আন্দোলনে নিহত এবং আহতদের খোঁজ খবর নেয়া শুরু করেন। খোঁজ নিয়ে প্রত্যেকের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে তিনি নিহতদের পরিবারের লোকজনকে সমবেদনা জানান। পাশাপাশি নিজের সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করেন। বিএনপি যদি ঢাকা-১৮ আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলতে চায় তাহলে এস এম জাহাঙ্গীরের বাইরে তেমন যোগ্য নেতা পাওয়া দুষ্কর। মাঠ পর্যায়ে যেমন গ্রহণযোগ্য, তেমনি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছেও আস্থাভাজন। কারণ অন্য প্রার্থীদের অনেকেই হাসিনার আমলে তাদের দলের এমপি-মন্ত্রী ও নেতাদের সাথে লিয়াজু করে চলেছে।
ঢাকা-১৮ আসনের বিভিন্ন থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিট ঘুরেও নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে-গত কয়েক মাস যাবত এসএম জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের ৩১ দফা দাবি আদায়ের লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি মানুষের মাঝে উৎসাহ উদ্দীপনা যুগিয়েছে। তিনি ঢাকা-১৮ আসনের অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি থানা, সেক্টর ও ওয়ার্ডে, ওয়ার্ডে তারেক রহমানের ৩১ দফা দাবির লিফটে বিতরণের মাধ্যমে স্থানীয় সাধারণ মানুষের হৃদয়ে যোগ্য নেতা হিসেবে জায়গায় করে নিয়েছেন।
এসএম জাহাঙ্গীর বাংলাভিশনকে বলেন, সাপ্তাহিক ছুটির দিন বাদে প্রতিদিনই কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকার আদালতে হাজির করা হতো। এই মামলায় না হয় ওই মামলায়-বছরের বেশির ভাগ সময় কেটেছে এভাবেই আদালতের বারান্দায়। প্রতিদিন কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে করে আনা-নেওয়ার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়তাম। মনে হতো এই বুঝি শেষ। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আজও বেঁচে আছি।
বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, ‘দেশের জন্য,গণতন্ত্রের মুক্তির জন্য তারা আন্দোলন করেছেন। ইতিহাসে মুক্তিকামী জনতাকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। তারাও করেছেন। সারা দেশে বিএনপির লাখ লাখ নেতাকর্মী ত্যাগ স্বীকার করেছেন,অনেকে জীবন দিয়েছেন,গুমের শিকার হয়েছেন,রক্ত দিয়েছেন, নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করেছেন। দলের দুই অভিভাবক ও কাণ্ডারি খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকেও সীমাহীন কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। মিথ্যা মামলায় বছরের পর বছর আটক রাখা হয়েছে। চিকিৎসা সুবিধাটুকু পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। সেই তুলনায় তার এই কষ্ট কিছুই নয়।’
বিভি/এআই
মন্তব্য করুন: