• NEWS PORTAL

  • সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

হজ: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস

মঈনুদ্দীন শামীম, সৌদি আরব থেকে

প্রকাশিত: ০০:৩০, ৬ জুলাই ২০২২

ফন্ট সাইজ
হজ: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস

বিশ্বের সকল দেশের মুসলমানদের বার্ষিক সম্মেলন হজ। দল, মত, গোত্র, বর্ণ নির্বিশেষে মুসলমান মাত্রই অর্থ ও শারীরিক ক্ষমতার অধিকারী হলে সৌদি আরব ও নিজ নিজ দেশের কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করা কিছু আনুষ্ঠানিকতাসাপেক্ষে হজ করতে পারেন।

ইসলামের মূল পাঁচটি খুঁটির একটি হলো হজ। আরবি ‘হজ’ শব্দের বাংলা অর্থ ‘সংকল্প করা’, ‘কোথাও যাওয়ার ইচ্ছা করা’। ইসলামি শরিয়াতের পরিভাষায় জিলহজ্জ মাসের নির্দিষ্ট তারিখে পবিত্র কাবা ঘরে তাওয়াফ, সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সায়ি, আরাফা মাঠ-মিনা-মুজদালিফায় অবস্থানসহ হযরত মুহাম্মদ (সা.) নির্ধারিত নিয়মে আনুষঙ্গিক ইবাদতসমূহ পালন করাকে হজ বলে। 

হজের ইতিহাস:
আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.) এর সময় থেকে পবিত্র কাবা শরিফের ইতিহাস শুরু। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জান্নাতে অবস্থিত ‘বায়তুল মামুর’ বরাবর ঠিক নিচে পবিত্র কাবা ঘরের ভিত্তি নির্মাণ করার জন্য আদেশ করেন। হাদিসে উল্লেখ আছে, এই বাইতুল মামুরে একসঙ্গে সত্তর হাজার ফেরেস্তা একবার তাওয়াফ করার পর আর সুযোগ পান না। মহান রাব্বুল আলামিন মানবজাতির জন্য তাওয়াফের এই অনন্য সুযোগ দিতে চান বলে হযরত আদম (আ.) কে এখানেই পবিত্র কাবা ঘর নির্মাণের জন্য আদেশ করেন। এটাই হল আল্লাহর ইবাদতের জন্য পৃথিবীতে নির্মিত প্রথম ঘর।

বহু শতক পরে আল্লাহর ইচ্ছায় হযরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) এই কাবা ঘর পুনঃনির্মাণ করেন। আল্লাহ ইব্রাহিম (আ.) কে বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী হাজেরার গর্ভে পুত্র ইসমাইল (আ.) কে দান করেন। তারপর তিনি আল্লাহর হুকুমে শিশুপুত্র ইসমাইল এবং হাজেরাকে ফিলিস্তিন ত্যাগ করে পবিত্র কাবা ঘরের কাছে রেখে আসেন। এরপর থেকে ইব্রাহিম (আ.), স্ত্রী হাজেরা এবং পুত্র ইসমাইলকে (আ.) নিয়েই মূলত হজ ও পবিত্র কাবা ঘরের ইতিহাস রচিত হয়। সে সময়ে এ এলাকাটি ছিল জনমানবশুন্য পাহাড়ি অঞ্চল। সেখানে ছিল না কোনো গাছপালা কিংবা জলাশয়। ইব্রাহিম (আ.) যখন তাদের রেখে ফিলিস্তিন চলে যাচ্ছিলেন হাজেরা তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন আপনি শিশুপুত্রসহ আমাকে বসবাসের এমন অযোগ্য জায়গায় রেখে যাচ্ছেন?’ ইব্রাহিম (আ.) নীরব থাকলে তিনি পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আল্লাহ কি আপনাকে এমনটি করতে আদেশ করেছেন?’ তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ।’ হাজেরা তখন বললেন, ‘তাহলে আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট।’

ইব্রাহিম (আ.) তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী হাজেরা ও প্রাণের টুকরো পুত্র ইসমাইলকে রেখে মক্কা ত্যাগ করেন। কয়েক মাস বয়সের পুত্র পানির পিপাসায় কাতর হয়ে কাঁদতে শুরু করলো। মা হাজেরা তখন এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছিলেন, কিন্তু কোথাও পানি পাচ্ছিলেন না। তিনি সাফা পাহাড়ের দিকে ছুটলেন, পানির মতো কিছু একটা দেখলেও মূলত তা কিছুই ছিল না, মারওয়া পাহাড়ের দিকে গিয়েও ব্যর্থ হলেন। শিশুপুত্রের কান্না শুনে তিনি দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। সাতবার কখনও দৌড়ে, কখনও জোর কদমে সাফা-মারওয়া প্রদক্ষিণ করেও পানি না পেয়ে আবার ছুটে এলেন ক্রন্দনরত শিশুপুত্র ইসমাইলের কাছে। এসেই বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, ইসমাইলের পায়ের নিচ থেকে তীব্র বেগে পানির ধারা বইছে। তিনি নিজে সে পানি পান করলেন এবং পুত্রকেও পান করালেন। এখনও সেই জায়গায় সেই পানি প্রবাহমান। এটাই ১যমযম পানি’, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানি।

হাজিগণ যখন মক্কায় হজ বা ওমরা করতে গেলে এই পবিত্র পানি পান করেন এবং হাজেরা ও ইসমাইল (আ.) এর স্মৃতিবিজড়িত সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার দৌড়ে ‘সায়ি’ করেন। এটি হজ্জ ও ওমরার অন্যতম একটি মৌলিক শর্ত।

কিছুদিন পর হযরত ইবরাহিম (আ.) তাঁর রেখে যাওয়া স্ত্রী-পুত্রকে দেখার জন্য এলেন। দেখলেন পুত্র  ইসমাইল চক্ষুশীতলকারী এক কিশোর। স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তিনি তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে কুরবানি করছেন। নবীদের স্বপ্ন সবসময় সত্য হয়। তিনি পুত্রকে তাঁর স্বপ্নের বিষয়টি জানালেন। আশ্চর্যের বিষয় হল ইসমাইল এই কুরবানির জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। সে পিতা ইব্রাহিম (আ.) কে বললো, ‘ইনশা আল্লাহ, আপনি আমাকে সবচেয়ে ধৈর্যশীল হিসেবে পাবেন।’

এ উদ্দেশে তাঁরা মিনায় এলেন। বালকটি ছিল খুব প্রাণবন্ত আর বৃদ্ধ ইব্রাহিম (আ) ছিলেন জ্ঞানে-গুণে আল্লাহর আদেশ পালনে দৃঢ়প্রত্যয়ী। পথে বারবার শয়তান তাদের পথভ্রষ্ট করার চেষ্টা করলো। ইব্রাহিম (আ.) তিনবার তিনটি স্থানে পাথর নিক্ষেপ করলেন। আল্লাহ খুশি হয়ে ইব্রাহিম (আ.) এর কুরবানি কবুল করলেন। ইসমাইলের পরিবর্তে একটি প্রাণী কুরবানি হলো। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই প্রতিবছর সারা বিশ্বের মুসলমানগণ হজের আনুষ্ঠানিকতা এবং ঈদুল আযহা উদযাপন করেন।

ইসমাইল ধীরে ধীরে বড় হলে আল্লাহ ইব্রাহিম (আ.) কে কাবা ঘর সংস্কার করার জন্য আদেশ করলেন। এ জন্য ইব্রাহিম (আ.) শ্যাম তথা ফিলিস্তিন থেকে মক্কায় এলেন। ইব্রাহিম (আ.) পুত্র ইসমাইলকে নিয়ে কাবা ঘর পুনঃনির্মাণ শুরু করলেন। তাঁরা দুজনে কিছুটা খনন করার পর পবিত্র ঘরের মূল ভিত্তিটি খুঁজে পান। সে অনুযায়ী তাঁরা নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। 

‘হাজরে আসওয়াদ’কে কাবা ঘরের এক কোণে স্থাপন করা হয়, এই কোণকেই তাওয়াফের সুচনাবিন্দু ধরে তাওয়াফ শুরু করা হয়। 

তারপর আল্লাহ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আ.) কে সমস্ত মানবজাতিকে হজের জন্য উদাত্ত আহবান জানাতে আদেশ করলেন। তাঁর এই আহবান যুগযুগ ধরে প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে সারা বিশ্বে।

[আর মানুষের নিকট হজের ঘোষণা দাও, তারা পায়ে হেঁটে, প্রতিটি ক্ষীপ্র উটের পিঠে চড়ে, তারা প্রতিটি গভীর ও দূরবর্তী পর্বতের গীরিপথ থেকে তোমার কাছে আসবে ] ২২ঃ২৭ 

তখন থেকেই প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ পবিত্র কাবা ঘরে হজ করতে আসেন। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর সময়ে নবম হিজরিতে হযরত আবু বকর (রা.) এর নেতৃত্বে তিনশ সাহাবিকে হজের জন্য পাঠানো হয়। দশম হিজরিতে হযরত মুহাম্মদ (সা.) স্বয়ং হজের নেতৃত্ব দেন। আরাফা ও মুজদালিফায় অবস্থান তাঁরই স্মৃতিধন্য। আরাফা ময়দানের জাবালে রাহমাত পাহাড়ে তিনি সমবেত মুসলমানদের সামনে অনন্তকালের বিশ্ববাসীর জন্য যে ভাষণ দেন, তা অনন্তকালীন ইতিহাসের অংশ। পরবর্তীকালে তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, ‘আমার কাছ থেকে হজ্জের নিয়মগুলো নিয়ে নাও।’ তাই রাসুল (সা.) এর দেখানো নিয়মই বর্তমানে হজ পালনের চূড়ান্ত নিয়ম। 

আজকাল প্রতিবছর ত্রিশ লাখের বেশি মুসলমান হজ পালন করেন। একই সঙ্গে বিশাল সংখ্যক মুসলমান সারা বছর ওমরা পালন করেন। সারা বিশ্বের মুসলমানদের জন্য বর্তমানে এক সর্বজনীন সমাবেশ-হজ। এভাবে ইব্রাহিম (আ.) এর আহবান বা দোয়া পরিপূর্ণ হয়ে চলেছে।  

লেখকঃ শিশুসাহিত্যিক, গবেষক, শিক্ষক
বি এ (সম্মান) এম এ,
এফ এম, এম এম ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
 

বিভি/এনএ

মন্তব্য করুন:

Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2