খালের জমি: পার্ক করতে চায় ডিএনসিসি, থানা বানাতে চায় পুলিশ!
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল দখলের অভিযোগে সাদিক এগ্রোসহ পাশের বস্তিতে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। একসময় এই খালের যেখানে মোহনা ছিল সেটি এরইমধ্যে ভরাট করা হয়েছে। সেই স্থানে সম্প্রতি মাঠ ও পার্ক বানানো হবে বলে অন্তত আধা ডজন সাইনবোর্ড লাগিয়েছে খোদ সিটি করপোরেশনই। একই জায়গায় মোহাম্মদপুর নতুন থানা নির্মাণের ঘোষণা দিয়ে আরও অন্তত ৫টি সাইনবোর্ড দিয়েছে পুলিশ। তবে দুই সংস্থার বড় বড় সাইনবোর্ডের মাঝে ঢাকা জেলা প্রশাসন আকারে ছোট্ট আরেকটি সাইনবোর্ড দিয়ে জানিয়েছে এটি রামচন্দ্রপু খালের জায়গা।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, সুরের ধারা স্কুলের নামে বেড়ীবাঁধ থেকে শুরু করে বিশাল জায়গা বাউন্ডারি করে রাখা হয়েছে। এই জমির শেষ অংশে রয়েছে সুরের ধারা নামের গানের স্কুলটির টিনসেড ঘর। ঘরটির বাম পাশে একটি ভরাট করা জমিতে তিন সংস্থা মিলে অন্তত এক ডজন সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। জেলা প্রশাসনের দেওয়া লাল রঙের একটি সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে সিএস/এস এ দাগ ৬৭১, আরএস দাগ ১৮৮০ এবং সিটি জরিপ ১১৪১৪ ও ১১৪০২ অনুযায়ী এটি জেলা প্রশাসনের ১ নম্বর খতিয়ানভুক্ত জমি। এখানে অবৈধ অনুপ্রবেশ দণ্ডনীয় অপরাধ বলেও উল্লেখ করা রয়েছে। এই সাইনবোর্ডটির পাশেই বড় বড় দুটি সাইনবোর্ড রয়েছে। এর মধ্যে কালো সাইনবোর্ডটিতে লেখা রয়েছে এটি মোহাম্মদপুর নতুন থানার নির্ধারিত স্থান। তারা শুধু ভরাট করা জমি নয়, খালের মাঝেও লাগিয়েছে একাধিক সাইনবোর্ড। অপরদিকে সিটি করপোরেশনের দেওয়া সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে এটি ‘শিশুদের খেলার মাঠ ও পার্কের জন্য নির্ধারিত স্থান, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এখানে প্রবেশ দণ্ডণীয় অপরাধ; নির্দেশক্রমে- মেয়র, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন।
স্থানীয়রা জানান, সুরের ধারা নামের স্কুলটির সামনের এই অংশটি ছিল তিনটি খালের সংযোগস্থল। প্রথমে ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গাটির আশপাশে ভরাট করে। তারপর এই জায়গাটি ভরাট করে তৈরি হয় ট্রাক স্ট্যান্ড এবং জাকির ডেইরি ফার্ম নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তবে ২০১৮ সালে ট্রাক স্ট্যান্ড এবং ডেইরি ফার্মটি উচ্ছেদ করা হয়। ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদের পর থেকে ভরাট করা বিশাল এই জায়গাটি খালি পড়ে আছে। তবে এটিকে খনন করে খালের রূপে ফেরত দিতে চেষ্টা করেনি কেউই।
আতাউর রহমান নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ট্রাক স্ট্যান্ডসহ সেবারও কয়েকটা বিল্ডিং ভাঙা হয়েছিল। আমরা ভেবেছিলাম খালটা প্রাণ পাবে। কিন্তু কদিন পরে দেখি সুরের ধারা ঘর তুলছে। সুরের ধারা বলছে, সরকার নাকি তাদের নামে এটি বরাদ্দ দিয়েছে। আবার সামনে মাঠ বানানো এবং থানা নির্মাণের সাইনবোর্ড দেওয়া হয়েছে। তাহলে অন্যদের উচ্ছেদ করার মানে কি বুঝলাম না।
এ বিষয়ে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বাংলাভিশনকে বলেন, এই খালের দখল নিয়ে আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছিলাম। কিন্তু অদৃশ্য কারণে সিটি করপোরেশনের নিরবতা ছিল। এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা উঠলো, সেটা দেখে হঠাৎ গিয়ে তারা শুধু একটা খামার আর বস্তির ঘর ভাঙলো। অথচ খালের মাঝেই গানের স্কুল রয়ে গেলো, ইউল্যাবের দখলকৃত অংশ এবং বহুতল ভবনও রয়ে গেছে। এখন আবার দেখছি সেখানে খেলার মাঠ করার সাইনবোর্ড দিয়েছে নগর প্রশাসন। আবার মোহাম্মদপুর থানা বলছে এটা নাকি থানা নির্মাণের জায়গা। সহজেই বলা যায়, এটা দুরভিসন্ধিমূলক।
আইনিভাবে খালের জায়গা স্কুল বা মাঠের জন্য দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই জানিয়ে, খালের জায়গা খালকে ফেরত দেওয়ারও দাবি জানান তিনি।
এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, নদী-খাল জনগণের সম্পত্তি। এটা কোনো সংস্থাকে দেওয়ার এখতিয়ার কারো নেই। আদালত নদী-খালকে জীবন্ত সত্ত্বা বলেছে এবং কেউ এটি হত্যা করলে ফৌজদারী অপরাধও হবে। জেলা প্রশাসক কোনোভাবেই খালের জমি অন্য কাউকে দিতে পারে না। যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ভারী বৃষ্টিপাত বেড়েছে পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে এখন সরকারের উচিত খাল ঠিক রাখতে প্রয়োজনে জমি অধিগ্রহণ করা, খালের জমি কাউকে দেওয়া নয়।
খালের জায়গায় মাঠ করার সাইনবোর্ড দেওয়ায় সিটি করপোরেশনের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে তিনি বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠান এভাবে খাল দখল করে মাঠ, থানা, বিশ্ববিদ্যালয়, মেট্রো স্টেশন বানালে খাল রক্ষাটা করবে কে? এভাবে চললে ক’দিন পরতো পানিতে ডুববে সবাই।
খালের জায়গায় থানা ও মাঠ করার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রশাসক আনিসুর রহমান বাংলাভিশনকে বলেন, আমরা থানা বা সিটি করপোরেশন কাউকেই এই জায়গা বরাদ্দ দেইনি। এটি খালের জায়গা ছিল খালের জায়গাই থাকবে। থানা আমাদের কছে দাবি করেছিল আমরা না করে দিয়েছি। কিন্তু সিটি করপোরেশন আমাদের সাথে যোগাযোগও করেনি। তারা কখন সাইনবোর্ড লাগিয়েছে আমরা জানি না। আমরা অবশ্যই তাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলবো। আপনাকে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি এখানে কোনো সংস্থাকে কিছুই করতে দেওয়া হবে না। এটা খালের জায়গাই থাকবে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বক্তব্য জানতে বার বার চেষ্টা করা হলেও ব্যস্ততা দেখিয়ে মেয়র কথা বলেননি।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: