ভোট দেওয়া নিয়ে সিদ্ধান্তহীন ৩০ শতাংশ তরুণ, পছন্দের দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১৭.৭
‘বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে রাজনৈতিক বিভাজন বিদ্যমান। ১৯.৬% তরুণ বিএনপিকে, ১৬.৯% জামায়াতে ইসলামীকে, ৯.৫% আওয়ামী লীগকে এবং ৩.৬% ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টিকে (এনসিপি) সমর্থন করেছেন। তবে, ৩০% তরুণ এখনও সিদ্ধান্তহীন যে, আসন্ন নির্বাচনে তারা কোন দলকে ভোট দেবেন; আর ১৭.৭% তরুণ পছন্দের দলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক।’
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের ভাবনা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, এবং আকাঙ্ক্ষা বোঝার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) পরিচালনা করেছে ‘ইয়ুথ ম্যাটারস সার্ভে ২০২৫’, যা সম্পূর্ণ সরাসরি সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। বুধবার (১২ নভেম্বর) ঢাকার বিওয়াইএলসি সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সার্ভের উক্ত ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
১০ থেকে ২১ অক্টোবর ২০২৫ তারিখের মধ্যে পরিচালিত এই সার্ভে বাংলাদেশের ৮টি বিভাগে ২৭টি জেলা ও ১৭৫টি প্রাথমিক নমুনা ইউনিটে অনুষ্ঠিত হয়। এতে ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী মোট ২,৫৪৫ জন তরুণ অংশগ্রহণ করেন। বিওয়াইএলসি প্রতি পাঁচ বছর পর পর জাতীয় নির্বাচনের আগে এই সার্ভে পরিচালনা করে, যাতে তরুণদের ভাবনা ও প্রত্যাশা প্রতিফলিত হয়।
ফলাফলে দেখা যায়, ৮৯% উত্তরদাতা নিবন্ধিত ভোটার, এবং ৯৭.২% আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে ইচ্ছুক। ৪৯.৮% উত্তরদাতা জানিয়েছেন যে, তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে আসন্ন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। এছাড়াও, ৬৩.১% উত্তরদাতা জানিয়েছেন যে, পূর্ববর্তী সরকারের তুলনায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়কালে তারা জনসমক্ষে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের মতামত প্রকাশে বেশি নিরাপদ বোধ করেন।
অধিকাংশ তরুণ (৫২.৬%) মনে করেন যে, ছাত্ররাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ন্যায়সঙ্গত ও নির্বিঘ্ন কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে ৪৮% রাজনৈতিক প্রভাবকে, ২৩.৮% সহিংসতা ও সংঘর্ষকে এবং ১১.১% ক্ষমতা ও সম্পদের অপব্যবহারকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
আগামী পাঁচ বছরে দেশের অগ্রাধিকার বিষয়ে প্রশ্নে ৬৭.১% উত্তরদাতা দুর্নীতি নির্মূলকেই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সামাজিক সম্প্রীতি বিষয়ে জানতে চাইলে ৬৫.৩% তরুণ জানিয়েছেন যে, ধর্ম ও জাতিগত দিক থেকে বাংলাদেশে এখনও সম্প্রীতি বজায় আছে। তবে, ৭৬% উত্তরদাতা মনে করেন, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে নারীরা নিরাপদ নন, যা স্থায়ী লিঙ্গভিত্তিক অনিরাপত্তার এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে এবং তাৎক্ষণিক নীতি-মনোযোগ দাবি করে।
ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে ৩৯.১% তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়তে আগ্রহী, আর ১৮.৩% জানিয়েছেন যে, তারা ভবিষ্যতে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের পরিকল্পনা করছেন, যার পেছনে মূল কারণ হলো কর্মসংস্থানের সীমিত সুযোগ ও সামাজিক-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে, ৫৯.৬% উত্তরদাতা মনে করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত তথ্য বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতা সঠিকভাবে উপস্থাপন করে না।
এইসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তরুণদের মাঝে আশাবাদ লক্ষ্য করা গেছে, ৬১.৭% উত্তরদাতা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইতিবাচক ও আশাবাদী মনোভাব প্রকাশ করেছেন, যা তাদের দৃঢ়তা, আশা এবং দেশের অগ্রগতিতে বিশ্বাসের প্রতিফলন।
ভয়েস ফর রিফর্মের সহ-সমন্বয়ক ফাহিম মাশরুর বলেন, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হতে চাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। প্রায় ৪০% তরুণ উদ্যোক্তা হতে চায়। এর পেছনে বড় কারণ চাকরি বাজারে যথেষ্ট সুযোগ না থাকা। অনেকে বাধ্য হয়েই উদ্যোক্তা হতে চায়। তবে, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ তাদের নেওয়া দরকার, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সেটা দেওয়া হয় না।
বিশিষ্ট মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডাক্তার আব্দুন নূর তুষার বলেন, বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে নানান ভাবনা কাজ করে। তারা শিক্ষা নিয়ে ভাবে, জীবিকা নিয়ে ভাবে। তাদের রাজনৈতিক ভাবনাও আছে। নানান বিষয় নিয়ে তারা হতাশাও ভোগে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও দেশের ৬১.৭% তরুণ দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী ও ইতিবাচক। বিওয়াইএলসির এই জরিপে তাই উঠে এসেছে।
বিওয়াইএলসির নির্বাহী পরিচালক তাহসিনাহ আহমেদ বলেন, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই বিওয়াইএলসি তরুণদের নিয়ে কাজ করে বলে দেশ ও সমাজ গড়ে তোলার ভূমিকায় তরুণদের সম্পৃক্ততা আর তাদের মতামত আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমীক্ষা দেখায় যে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম রাজনৈতিকভাবে সচেতন, সামাজিকভাবে জাগ্রত এবং দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে। তরুণরা তাদের আকাঙ্ক্ষা ও আশঙ্কার কথা বলেছেন এবং তারা অনিশ্চয়তার মধ্যেও অনেক আশাবাদী। তাদের কথা শোনা, তাদেরকে সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা এবং তাদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিনির্ধারণ করা এখন ভীষণভাবে জরুরি। শান্তি ও ন্যায়বিচার বিষয়ে মত প্রকাশ করতে গিয়ে জান্নাতুল মাওয়া, সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, বিওয়াইএলসি, বলেন, সামনের দিনে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসবেন কিংবা নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে যাবেন, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আস্থা ফেরানোর দিকে মনোযোগ দেওয়াটা খুবই জরুরি বলে আমি মনে করি।
বিওয়াইএলসির লিড ফ্যাকাল্টি মুনিরা সুলতানা মন্তব্য করেন, আমাদের দেশের তরুণদের আছে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষমতা। তাদের শুধু সঠিক দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং উন্নতির সুযোগগুলো কাজে লাগাতে হবে।
বিভি/পিএইচ




মন্তব্য করুন: