হালখাতায় সংকটের হিস্যা

বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী জীব হলো মানুষ। আধুনিক মানুষ, অর্থাৎ হোমোস্যাপিয়েন্স প্রজাতির প্রাণী।যাদের চিন্তা করবার ও তার প্রয়োগের ক্ষমতা এই পৃথিবীর প্রাণীকুলের মধ্যে একমাত্র। মনের ভাব আদান প্রদান ও ভাবকে কাজে রুপান্তরের ক্ষমতা আছে মানুষের। কিন্তু এই ক্ষমতাই কি মানবের অস্বস্তিতের জন্য সংকটময় অবস্থা তৈরি করছে?
মানুষ ১০,০০০ বছর আগেও খাদ্য ও বাসস্থানের নিশ্চয়তার জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলেছে । হিংস্র পশুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করাই ছিল একমাত্র বিষয়।নিজের বুদ্ধি, জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সংঘবদ্ধতায় পরিনত হওয়া, কৃষি ব্যবস্থা, এবং আরও উন্নত যাপনব্যবস্থায় পরিণত করেছে জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে। তাঁরকাটা বিহীন পৃথিবীকে একটু একটু করে এক আবদ্ধতায় পরিনত করেছে জাতি, বর্ন , ভাষা ও ধর্মের ভিত্তিতে। মানুষ চিত্রকলা,ও লেখার মধ্যে দিয়ে নিজেদের পূর্বের ইতিহাস কে সংরক্ষিত করেছে।
"মানুষ তার চিন্তাধারা ও কর্মের মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকে"
- কার্ল মার্ক্স
মানুষ তার চিন্তা ও কর্ম দ্বারা বেঁচে থাকতে চেয়েছে সবসময়ই, কর্মের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে উন্নতির শিখরে, প্রক্ষান্তরে মানুষ প্রভাব বিস্তার করেছে আগ্রাসী মন নিয়ে ,এবং তা সবদিকে। জ্ঞান, বিজ্ঞানের প্রভাব বিস্তার হয়ে দাড়িয়েছে মানবকূলের অস্বিত্ব সংকটে।সংকট থেকে সংকটাপন্ন অবস্থা।
এই অভেদ্য বিষয়কে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন শিল্পী সাইদুল হক জুইস। শিল্পী মাত্রই সচেতন ও আত্ম ক্রন্দন সম্পন্ন । শিল্পী সৃষ্টি করে ধ্বংস তার ধাঁচে নেই।মানবের মধ্যে পঁচে যাওয়া আত্না ও তার গন্ধ শিল্পীকে নাড়া দিচ্ছে,শিল্পী সুন্দর থেকে ক্রমশ দুরে চলে যাচ্ছে এবং শিল্পে ক্ষিপ্ততার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
"পোশাক হলো বাইরের আবরণ,মানুষের আসল সৌন্দর্য তার জ্ঞানে"
-সক্রেটিস
জ্ঞান ও বোধ মানুষ সঠিক পথে ব্যবহার করলে হয়তো মানুষ থাকা যায় কিন্তু জ্ঞানহীনতা হিংস্রতার দিকে ঠেলে দেয়।মানুষ পুঁজির স্তর থেকে সাম্রাজ্যবাদ, সেখান থেকে আধিপত্যবাদ, সবকিছু নিয়ে এক হিংস্র খেলায় মেতেছে। বোধ এখানে নিঃক্রিয়,ঠিক এখানেই দাড়িয়ে শিল্পী জুইস তারকাঁটার বেড়াকে উপেক্ষা করছেন, এই সীমানাই বার বার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের অন্যতম কারণ হয়ে দাড়িয়েছে তা তিনি স্পষ্ট করছেন।
কখনো মান্টোর লেখায় কখোনো ঋত্বিক ঘটকের সিনেমায় বা সুলতানের আঁকায় এই সাম্রাজ্যেবাদের বলিদানের গল্প আমার পেয়ে আসছি। সময় আর্ট গ্রুপের অন্যতম একজন শিল্পী জুইস, গ্যালারী কলাকেন্দ্রে সময়ের গল্প করলেন স্থাপনা শিল্পের ভাষায়, প্রকাশ করলেন নিজের ভেতরের ক্ষোভ এবং তা বিশ্বমানবের প্রতিনিধি হিসাবে। খুললেন পুরনো হিসাবের খাতা, কালের হালখাতা শিরোনামে।এই খাতায় হিসাব আছে মানবতার ক্ষয়ে যাওয়ার হিসাব, তিনি শিল্পকর্মে পুঁজি পতিদের প্রতিনিধি হিসেবে ধূর্ত কাককে এনেছেন সফল ভাবে। উপনিবেশবাদ ধ্বংস করছে স্থানিক সংস্কৃতি হুমকির মধ্যে পড়ছে ধর্ম, ভাষা, খাদ্যাভাস বাড়ছে সংঘাত, লম্বা হচ্ছে লাশের সারি। শিল্পী জুইস সারি, সারি লাশের মিছিল দেখিয়েছেন কিন্তু এই গুলো কোন হিংস্র প্রাণীর আঘাতে নয় মানব দ্বারা পরিচালিত সংঘাতে এই মৃত্যু মিছিল।
"অন্যকে কখনো নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করো না, নিয়ন্ত্রণ করো কেবল নিজেকে"
- গৌতম বুদ্ধ
অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করা য়ায় না, নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন নিজের আত্নার। কিন্তু আধুনিকতাবাদ নিয়ন্ত্রন হীনতার দিকে ধাবিত করছে নিয়ত। শিল্পী জুইস " কালের হালখাতা " শিরোনামে স্থাপনা শিল্পের প্রদর্শনী দেখলে বোঝা যায়, তিনি হিসাবের খাতা খুলেছেন তা পুরাতন দেনা পাওনা নয়।তিনি লাল কাপড়ে মোড়ানো মানবের বিবেকের অস্বিত্বের দেনা পাওনার হিসাব খুলেছেন। কলাকেন্দ্রের দেয়ালে ধিক্কার জানাচ্ছেন, মানুষ যখন নিজেই নিজেদের অস্থিমজ্জা, হাড় খাদ্য তালিকায় স্থান করে দিয়েছে এবং ধূর্ত প্রাণী তা অবলোকন করছে লোলুপতায়।
তা হলে মানুষের বোধ,জ্ঞান, তার সৃষ্টির ক্ষমতা সবকিছু কি শুন্য? হাজার বছর ধরে হেঁটে আসা সভ্যতা কি মিথ্যা। বন্যপ্রাণী না মানুষ বেশি হিংস্র?
" মানুষ ছাড়া ক্ষপারে তুই মূল হারাবি, মানুষ ভোজলে সোনার মানুষ হবি"
- ফকির লালন সাঁই
মানুষ ভোজলে সোনার মানুষ হওয়া যায় কিন্তু আধিপত্যবাদকে পৃথিবীর মানুষ আলিঙ্গন করেছে মানবতা কে নয়। শিল্পী জুইসের হালখাতায় সংকট নয়,ধূর্তার হিসাব নয়, থাকবে মানব প্রেমের সমীকরণ। সমাধান হবে সংকটের, সেই প্রত্যশায় বিশ্বমানবতা।
লেখক: চিত্রশিল্পী ও লেখক
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: