নজরুল মিন্টোর ‘উত্তর আমেরিকার চালচিত্র’ ও ‘নিঃশেষে নৈবেদ্য’র প্রকাশনা উৎসব

‘উত্তর আমেরিকার চালচিত্র’ নাম দেখে মনে করবেন ইতিহাস। আবার কারো কারো মনে হতে পারে প্রবন্ধ; কারো বা মনে হবে ভ্রমণ কাহিনী; কারো বা মনে হবে গবেষণাকর্ম। আমি প্রথমে মনে করেছিলাম সমাজ ও সংস্কৃতিবিষয়ক গবেষণা। কিন্তু গ্রন্থটি পড়ার পর আমার ধারণা অসার প্রমাণিত হলো। বুঝলাম এটি ওপরে বর্ণিত সবকটি সাহিত্য প্রত্যয়ের সমাহারে সমৃদ্ধ আর অপূর্ব নান্দনিকতায় সজ্জিত একটি জীবনীগ্রন্থ।
‘উত্তর আমেরিকার চালচিত্র’ বইটি সম্পর্কে এভাবেই মূল্যায়ন করলেন কানাডার অটোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আমীন।
রবিবার সন্ধ্যায় ঢাকার বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে কানাডা প্রবাসী লেখক ও সাংবাদিক নজরুল মিন্টো রচিত ‘উত্তর আমেরিকার চালচিত্র’ ও 'নিঃশেষে নৈবেদ্য' নামে দুটি বইয়ের প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।
এতে ড. আমীন উত্তর আমেরিকার চালচিত্রকে অপূর্ব নান্দনিকতায় সজ্জিত একটি জীবনীগ্রন্থ হিসেবে মূল্যায়িত করলেও লেখকের মতে, তাঁর এই বইটি একটি ‘নন ফিকশন ন্যারেটিভ’।
বইয়ের নানা অধ্যায়ে উঠে এসেছে বিদেশে নাগরিকত্ব গ্রহণের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন, কর্মস্থলে জাতিগত পরিচয় সংকট, সন্তানদের নিয়ে ভবিষ্যতের দোলাচল, কিংবা আত্মীয়-স্বজনহীন একাকিত্বের দীর্ঘশ্বাস- যা শুধু ব্যক্তিগত নয় বরং এক সার্বিক অভিবাসী অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি। তবে এসবের মাঝেও বিষদগার হয়ে ওঠেনি। বরং লেখকের ভাষা-নিরীক্ষা, অন্তর্দৃষ্টি ও স্বভাবসিদ্ধ রসবোধে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পাঠ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে।
এদিকে নিঃশেষের নৈবেদ্য গ্রন্থটি প্রবাসী জীবনের অজানা অন্ধকার আর হারিয়ে যাওয়া স্বপ্নের কাহিনী নিয়ে রচিত। যারা একদিন উন্নত বিশ্বের আলো ঝলমল শহরে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায়, তাদের অনেকেই হারিয়ে গেছেন নির্মম বাস্তবতায়। এই বই সেইসব মানুষদের গল্প বলে- যেখানে প্রবাস নয় বরং পরবাস হয়ে ওঠে এক নিঃশেষ যাত্রার প্রতীক।
অনুষ্ঠানে নিঃশেষের নৈবেদ্য নিয়ে বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ সুজিত মোস্তফা বলেন, প্রতিটি লেখায় উঠে এসেছে সংসারের টানাপোড়েন, সম্পর্কের জটিলতা আর লোভ-লালসার করাল চেহারা। কেউ খুন হয়েছেন, কেউ নিখোঁজ; কেউ রেখে গেছেন অনাথ সন্তান- যারা বড় হচ্ছে প্রশ্নবিদ্ধ নীরবতায়। নানান তথ্য অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধিতে নির্মিত প্রতিটি গল্পেই আছে লেখকের প্রজ্ঞা, জীবন বোধ এবং গভীর মানবিকতা। শুধুমাত্র একটি বই নয়, এটি প্রবাসের অন্তর্লীন বেদনার দলিল।
বই দুটির প্রকাশনা উৎসব ঘিরে লেখক-পাঠকদের রীতিমত মিলনমেলা ঘটে। এ অনুষ্ঠানে বইটির লেখক, উত্তর আমেরিকা ভিত্তিক ‘দেশে বিদেশে’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক নজরুল মিন্টোও উপস্থিত ছিলেন।
কবি ও গবেষক অপূর্ব শর্মার সঞ্চালনায় প্রকশনা উৎসবে অতিথি ছিলেন কবি ও লেখিকা রোমানা চৌধুরী, সাংবাদিক আনিস আলমগীর, রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান সালিম সাবরিন, ডক্টর শাহজাহান মাহমুদ, লেখকের সহধর্মিনী আফিয়া খানম। এতে আলোচনা করেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি বায়েজিদ আহমেদ, প্রচ্ছদ শিল্পী তাসিন, লেখক রাজিবুল হাসান, মোহাম্মদ সাইফুল হাসান, আবৃত্তি শিল্পী লুলুয়া ইসহাক মুন্নি। সংগীত পরিবেশন করেন সংগীতজ্ঞ সুজিত মোস্তফা, শিল্পী লাভলী দেব, ব্যাংকার রুম্পা চৌধুরী ও নিশি কাওসার।
অতিথিরা বক্তব্যে জানান, নজরুল মিন্টো তরুণ বয়স থেকেই লেখালেখি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত। আশির দশকেই তাঁর উদ্যোগে ফেঞ্চুগঞ্জে প্রথম সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হয়। প্রবাসের কর্মব্যস্ত জীবনেও তিনি তার লেখালেখি ও সংস্কৃতিসেবা অব্যাহত রেখেছেন। নজরুল মিন্টো’র লেখার ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা রয়েছে। তার চিন্তার ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা রয়েছে। এই মুন্সিয়ানা দিয়েই তিনি সমাজকে বিশ্লেষন করেছেন বই দুটিতে। এছাড়া সেখানকার আদিবাসী সম্প্রদায়, দরিদ্র শিশু, অভিবাসী, বাংলাদেশের যুদ্ধশিশুদের প্রতি যে দরদ বিভিন্ন লেখায় ফুটে ওঠেছে এতে তার মানবিক ও সংবেদনশীল হৃদরেয়রও সন্ধান পাওয়া যায়।
বই দুটির প্রকাশক অভ্র প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী অপূর্ব শর্মা বলেন একাত্তরে নির্যাতিত নারীদের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে ‘যুদ্ধশিশু’ শব্দটি বাংলায় নজরুল মিন্টো'ই প্রথম ব্যবহার করেছেন। যা নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।
অনুষ্ঠানে সবশেষে বক্তব্য রাখেন বই দুটির লেখক নজরুল মিন্টো। তিনি উপস্থিত সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি তার লেখালেখি ও সাংবাদিক জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এসময় উপস্থিত পাঠকদের বিভিন্ন প্রশ্নেরও উত্তর দেন লেখক।
২৫৬ পৃষ্টার বই উত্তর আমেরিকার চালচিত্রে বৈচিত্রপূর্ণ ৬৬ টি লেখা রয়েছে। যেখানে উঠে এসেছে উত্তর আমেরিকা তথা কানাডা ও আমেরিকার ইতিহাস, সেখানকার জীবন, জীবিকা, প্রকৃতি ও সংস্কৃতি, কানাডার অভিবাসীদের সুখ-দুঃখ, আশা ও হতাশার গল্প, প্রবাসে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ান। সুখপাঠ্য বইটি ঘন্টা তিনেকেই পাড়ে নেওয়া যায়। এ যেন ঘন্টা তিনেইে উত্তর আমেরিকা ভ্রমণ করে ফেলার অনুভুতি।
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: