• NEWS PORTAL

  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪

যে লাইব্রেরির বই পড়তে হলে বেঁচে থাকতে হবে ২১১৪ সাল পর্যন্ত

প্রকাশিত: ০৭:২৯, ৮ জুলাই ২০২২

ফন্ট সাইজ
যে লাইব্রেরির বই পড়তে হলে বেঁচে থাকতে হবে ২১১৪ সাল পর্যন্ত

নরওয়ের রাজধানী অসলো'র উত্তরে একটি বন আছে। খুব বেশিদিন হয়নি এ বনের গাছগুলো লাগানো হয়েছে। গাছগুলো মোটে তিন ফুটের মতো লম্বায় বেড়েছে। স্প্রুস নামের এ বৃক্ষরাজি রোপণ করার পেছনে একটি উদ্দেশ্য রয়েছে।

সুদূর ভবিষ্যতে যখন এগুলোর আকৃতি এখনকার চেয়ে ২০-৩০ গুণ বেশি হবে, তখন কিছু বিশেষ বই লেখার জন্য এ বনের গাছ থেকে কাগজ তৈরি করা হবে। তবে এখন যারা বেঁচে আছেন, ওই বনটিতে পিকনিক করতে যাচ্ছেন, তারা জানেন, নিজেদের জীবদ্দশায় এ বইগুলো তারা কখনো পড়ে যেতে পারবেন না।

স্কটিশ শিল্পী কেইট প্যাটারসন ও তার নরওয়েজিয়ান সঙ্গী অ্যান বিট হোভিন্ড ফিউচার লাইব্রেরি নামের একটি প্রকল্পের সূচনা করেছেন। তাদের সঙ্গে রয়েছে আরও একদল ট্রাস্টি। ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবছর তারা এ ভবিষ্যৎ লাইব্রেরির একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

তাদের এ প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছে আগামী ১০০ বছরের জন্য। প্রতি বছর অনুষ্ঠানে যেকোনো একজন প্রখ্যাত লেখককে তার একটি পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। এ প্রক্রিয়া চলবে আগামী ২১১৩ সাল পর্যন্ত। এরপর ১০০ বছরের জমা পড়া সব পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করবে ফিউচার লাইব্রেরি।

মার্গারেট অ্যাটউডের 'স্ক্রিবলার মুন' নামক একটি ছোটগল্পের পাণ্ডুলিপি দিয়ে এ লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর এ যাত্রায় সঙ্গী হয়েছেন ইংরেজ ঔপন্যাসিক ডেভিড মিচেল, আইসল্যান্ডের কবি শিওন, তুরস্কের এলিফ শাফাক, দক্ষিণ কোরিয়ার হান ক্যাং, ও ভিয়েতনামিজ-মার্কিন কবি ওশেন ভুওং প্রমুখ।

২০২২ সালে ফিউচার লাইব্রেরির জন্য পাণ্ডুলিপি জমা করেছেন জিম্বাবুয়ের লেখক সিতসি ড্যানগারেম্বগা ও নরওয়েজিয়ান লেখক কার্ল ওভ নসগার্ড। এ সাহিত্যিকেরা তাদের পাণ্ডুলিপির আধেয় প্রকাশ করতে পারেন না, কেবল শিরোনাম জানাতে পারেন।

এ পাণ্ডুলিপিগুলো রাখা হচ্ছে অসলোর প্রধান পাবলিক লাইব্রেরিতে, কাচের তৈরি আবদ্ধ ড্রয়ারে। যেখানে রাখা হচ্ছে, তার নাম দেওয়া হয়েছে 'নিশ্চুপ কক্ষ' বা সাইলেন্ট রুম। ২১১৪ সালে এ ড্রয়ারগুলোর তালা খোলা হবে, বড় হয়ে যাওয়া গাছগুলো কাটা হবে। এরপর শতবছর গোপনে রাখা ১০০টি গল্প একসঙ্গে প্রকাশ করা হবে।

'এ লাইব্রেরিতে যেসব লেখকের বই থাকবে, তাদের বেশিরভাগের এখনো জন্মই হয়নি,' বলেন প্যাটারসন। কিন্তু আজকের মানুষ যে লাইব্রেরির বই পড়তে পারবে না, তা তৈরি করা কেন? এ লাইব্রেরির গল্পগুলো থেকে কী জানা যাবে?

মানুষের মধ্যকার সম্পর্ককে লম্বা সময়ের দৃষ্টিতে ধরার চেষ্টার অংশ হিসেবে গড়ে উঠেছে ফিউচার লাইব্রেরি। তবে এ থিমটুকু নিয়ে আগেও কাজ করেছেন প্যাটারসন। একসময় আইসল্যান্ডে ছিলেন তিনি। সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশের অপরূপ সৌন্দর্য্যে বিমুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি।

তা থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের প্রথম কাজটি করেছিলেন তিনি। সেটি ছিল একটি টেলিফোন নাম্বার। ওই নাম্বারে ফোন করে যে কেউ আইসল্যান্ডের হিমবাহ ভাঙার আওয়াজ শুনতে পেত। প্যাটারসন ওই প্রজেক্টের নাম দিয়েছিলেন 'ভাটনাজোকুল'। এরপর থেকে সময়কে ধারণ করে এমন অনেকগুলো প্রকল্প নিয়ে কাজ করেছেন তিনি।

দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষা

ফিউচার লাইব্রেরির পরিকল্পনা করার সময় উদ্যোক্তারা দীর্ঘমেয়াদের বিষয়টিতেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আর এ বছর লাইব্রেরিটির ভবিষ্যতের পথচলা সুনিশ্চিত হলো। অসলো শহরের নেতারা এ বন ও লাইব্রেরিটি আগামী ১০০ বছর তারা ও তাদের উত্তরসূরীদের মাধ্যমে রক্ষা করার বিষয়ে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন।

এ প্রকল্পটি প্যাটারসন ও তার সহকর্মীরা এমনভাবে নকশা করেছেন যাতে বাকি বিশ্ব অনুধাবন করতে পারে কীভাবে কোনো কিছুকে দীর্ঘকালীনভাবে সংরক্ষণ করা যায়। ছোট সময়ের গণ্ডি থেকে বাইরে বেরিয়ে সময়কে আরও বিস্তৃত পরিসরে দেখতেও ভূমিকা রাখবে এ ফিউচার লাইব্রেরি।

একুশ শতকে এসে আমরা আমাদের উত্তরসূরীদের জন্য অনেক কিছুই রেখে যাচ্ছি। তবে তার বেশিরভাগই তাদের জন্য পৃথিবীতে বাস করা আরও কঠিন করে তুলবে: উষ্ণ পরিবেশ, সমুদ্রে প্লাস্টিক বর্জ্য, ভূ-অভ্যন্তরে নিউক্লিয়ার বর্জ্য ইত্যাদি। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য আমাদের প্রজন্ম বলার মতো তেমন কোনো অবদান রেখে যাচ্ছে না।

ফিউচার লাইব্রেরিকে একপ্রকার 'লিগেসি লাইব্রেরি' হিসেবেও ব্যাখ্যা করা যায়। তবে এটাকে কোনোভাবে ত্যাগের নমুনা হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। এ লাইব্রেরির একজন সমালোচনাকারী বলেছিলেন, এটি একটি বনেদী টাইম ক্যাপসুল যেখানে গণমানুষের কোনো অধিকার নেই। তবে এই সমালোচনাটুকুও নির্দ্বিধচিত্তে মেনে নেওয়া যায় না।

ভবিষ্যতের মানুষদের জন্য এত আয়োজন করার মানে কি তবে বর্তমানের আনন্দকে ত্যাগ করা? ফিউচার লাইব্রেরি নিয়ে এমন কথাও উঠেছে অনেক সময়। তবে ফিউচার লাইব্রেরি প্রমাণ করছে, ভবিষ্যতকে কিছু দেওয়ার জন্য বর্তমান থেকে কিছু নেওয়ার দরকার নেই।

এ কথা অনস্বীকার্য যে ফিউচার লাইব্রেরির বই এ জমানার কেউ পড়তে পারবে না। কিন্তু ওই জঙ্গলে একটু ঘুরে আসাতে কোনো অসুবিধা নেই। ওখানে অবশ্য প্রায়ই মানুষ পরিবার নিয়ে দলবেঁধে ঘুরতে যান, হাইকিং করেন অনেকে। এছাড়া মাউন্টেইন বাইকারদেরও এ জঙ্গলে নিয়মিত দেখা যায়। এছাড়া লাইব্রেরির সাইলেন্ট রুমেও চাইলেই কিছুক্ষণ সময় কাটানো যায়।

সাইলেন্ট রুমে ঢুকলে মনে হতে পারে যেন ভিন্ন একটি দুনিয়ার পোর্টাল খুলে গেল চোখের সামনে। কক্ষটি প্রথমবার দেখলে মনে হবে বুঝি কাঠের তৈরি কোনো গুহার অভ্যন্তরভাগ। ভেতরে প্রবেশ করতে হলে জুতা খুলে বাইরে রাখতে হয়। ভেতরের দেয়ালের গায়ে কাচের দরজায় আটকানো ১০০টি ছোট ছোট চেম্বার।

ফিউচার লাইব্রেরিকে নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি সম্প্রদায়ও। এ লাইব্রেরির সুবাদে সংশ্লিষ্ট মানুষজনের মধ্যে এক ধরনের আত্মিক বন্ধন গড়ে উঠেছে। গত আট বছর ধরে এ মানুষগুলো ফিউচার লাইব্রেরির জন্য একত্রে কাজ করেছেন। হোভিন্ড এটাকে 'ফিউচার লাইব্রেরি পরিবার' হিসেবে অভিহিত করেছেন।

প্যাটারসন যদি ফিউচার লাইব্রেরি নিয়ে একা কাজ করে যেতেন, তাহলে এ লাইব্রেরির ভবিষ্যত কেবল তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সক্ষমতার ওপর নির্ভর করতো। কিন্তু এখন যেহেতু এর সঙ্গে একটি গোষ্ঠী জড়িয়ে গেছে, তাই এ লাইব্রেরিকে শতবর্ষী করার পরিকল্পনা বিশেষ কোনো ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে মনে করেন না সংশ্লিষ্টরা।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হওয়া ও খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ফিউচার লাইব্রেরির। এ লাইব্রেরি যারা ভবিষ্যতে পরিচালনা করবেন, তারা লাইব্রেরিটিকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবেন সে সিদ্ধান্ত তারাই নিতে পারবেন।

আগামী শতকের লেখকদেরকেও প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। আবার যখন ওই চেম্বারগুলো খোলা হবে, তখন ভবিষ্যত লাইব্রেরি পরিচালকেরা যদি মনে করেন তারা কোনো পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করবেন না, তাহলে ওই লেখককে তার জন্য আক্ষেপ করতে হবে না। কারণ তিনি ততদিনে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নেবেন। এ বিষয়টিকে নিজেদের জন্য স্বাধীনতা হিসেবে দেখছেন পাণ্ডুলিপি জমা দেওয়া বর্তমানের অনেক সাহিত্যিক।

তবে সবমিলিয়ে ফিউচার লাইব্রেরি হচ্ছে আশার একটি প্রকাশ। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের সামনে যে সম্ভাবনাগুলো থাকতে পারে, তার প্রতি একটি আত্মবিশ্বাসের বার্তা এ লাইব্রেরিটি।

মূল লেখা: রিচার্ড ফিশার, বিবিসি

বিভি/এনএম

মন্তব্য করুন: