• NEWS PORTAL

  • মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৫

ইউপিডিএফ’র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড: পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৬ বছরে ১৭৪ জনকে হত্যা, অপহরণ ৩৫০

চট্টগ্রাম ব্যুরো

প্রকাশিত: ১৩:৩২, ১৪ অক্টোবর ২০২৫

আপডেট: ১৩:৪২, ১৪ অক্টোবর ২০২৫

ফন্ট সাইজ
ইউপিডিএফ’র সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড: পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৬ বছরে ১৭৪ জনকে হত্যা, অপহরণ ৩৫০

ছবি: প্রসীত খীসা

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ’র সন্ত্রাসী কর্র্মকাণ্ডে গত ১৬ বছরে বাঙালি-পাহাড়ি মিলিয়ে ১৭৪ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন দুই শতাধিক। এসময় ২৭৮ বার অপহরণের ঘটনায় অপহরণ করা হয় ৩৫০ জনকে।

শুধু নিরাপত্তাবাহিনীর সাথে এখানে ২৬ বার গুলি বিনিময়ের ঘটনা ঘটে। তাই এক সময়ের উত্তপ্ত জনপদ পার্বত্য চট্টগ্রাম আজও  বয়ে বেড়াচ্ছে এক গভীর ও অন্ধকার অধ্যায়ের স্মৃতি। এর নেপথ্যের মূল কারিগর ইউপিডিএফ প্রধান প্রসীত খীসা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, দেশের বাইরে ত্রিপুরা ও মিজোরামে অবস্থান নিয়ে প্রসীত খীসা তার অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। 

২০০১ সালে রাঙামাটির নানিয়ার চরে ইউপিডিএফ ৩জন বিদেশি নাগরিককে অপহরণ করে।মুক্তিপণ হিসেবে ৩ কোটি টাকা আদায়ের অভিযোগ রয়েছে। এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্গনের উদাহরণ। যা সাধারণ নাগরিকদের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে।

২০০২ সালের ৫-৬ এপ্রিল রাঙ্গুনিয়া রানীর হাটের বাঁশ ব্যবসায়ী ওমর আলী হাজীকে চাঁদা না দেওয়ার কারণে ইউপিডিএফ ১০ রাউন্ডি গুলি করে হত্যা করে। বিরোধের জেরে থুইমং মারমার বাড়িতে দেওয়া আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কাউখালী-কচুখালীতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়।যাতে পাহাড়ি-বাঙালি উভয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।    

২০০৩ সালের ২৬ আগস্ট খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে ইউপিডিএফ একজন বাঙ্গালিকে নির্মমভাবে হত্যা করে।এর ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। যাতে ইউপিডিএফ ও উপজাতীয় গোষ্ঠী সমন্বিত আক্রমন করে। এতে শত শত মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়। ২০০৬ সালে রাঙামাটির নানিয়ারচর মাইসনছড়িতে ইউপিডিএফ অতর্কিতভাবে ক্যাপ্টেন গাজীকে হত্যা করে। ২০১১ সালের ২১ ফ্রেব্রুয়ারি কাউখালী কলেজে ২১ ফ্রেব্রুয়ারি পালনের বিরোধিতা করে ইউপিডিএফ।বাঙালি ছাত্ররা ফুল দিতে গেলে বাঁধা দেয়। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়।  

২০১২ সালের ১৩ জুন মাটিরাঙার দক্ষিণ কুমিল্লা টিলায় আবদুল মান্নানের মেয়ে কুলসুম আক্তারকে ৪ জন ইউপিডিএফ সদস্য ধর্ষণ করে। একই বছরের ২৩ জুলাই মহালছড়ির মাইসছড়িতে শাহেদা বেগম এবং ৯ অেক্টোবর মহালছড়ির শ্মশান খোলায় শামছুন্নাহার ধর্ষণের শিকার হন। যাতে তার মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে।

২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর নানিয়ার চরে চাঁদা না পেয়ে ইউপিডিএফ ১২ কর আনারস বাগান এবং ২০ হাজার সেগুন গাছের চারা ধ্বংস করে। লক্ষাধিক আনারস গাছ কেটে বাঙালিদের উপর নৃশংস হামলা চালানো হয়। ২০১৫ সালের ১২এপ্রিল দীঘিনালার ক্ষেত্রলাল ত্রিপুরার মেয়ে দীপা ত্রিপিুরা ইউপডিএফ সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ, অপহরণপূর্বক ঝুম ঘরে আটকে রেখে গণধর্ষণ এবং মোবাইলে ভিডিও করে।  

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে গুইমারায় উমাচিং মারমা এক বাঙ্গালি ছেলেকে বিয়ে করার অপরাধে নির্যাতিত হয়। তার পরিবারকে মোটা অংকের চাঁদা দিতে হয়।একইভাবে মাটিরাঙ্গার সোনাবি চাকমা, কুতুকছড়ির রিনা ত্রিপরা, রামগড়ের মণিকা ত্রিপুরা, নানিয়ার চরের জোস্না চাকমা ও (আয়েশা সিদ্দিকা) মিনুরওজা মারমাকে অপহরণের পর ধর্ষণ শেষে হত্যা করা হয়।

২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর মাটিরাঙ্গার বাইল্যাছড়িতে চলন্ত বাস থেকে নয়ন ত্রিপুরা ওরফ ফাতেমা বেগমকে তার স্বামীর সামনে অপহরণ করা হয়। এখনো তাকে উদ্ধার করা যায়নি। লেখিকা রোকেয়া লিটার ডুমুরের ফুল উপন্যাসে এই ধরণের ঘটনা তুলে ধরায় তাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। 

২০১৭ সালের ১০এপ্রিল রাঙামাটির ঘিলাছড়িতে মোটর সাইকেল চালক সাদিকুল ইসলামকে ইউপিডিএফ হত্যা করে লাশ মাটিতে পুঁতে রাখে। পরে পুলিশ লাশ উদ্ধার করে। ২০১৯ সালের ৩ মে ইউপিডিএফ গুলি করে হত্যা করে নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে। এসময় ৬-৭জন নিহত হয়। 

২০১৯ সালের ১৮মার্চ নির্বাচন শেষে ফেরার পথে দীঘিনালা- বাঘাইছড়ি সড়কের নয়মাইলে ইউপিডিএফ সন্ত্রাসীদের গুলিতে ৬জন নিহত হয়।এছাড়া আহত হয় ১৬ জন। তারা নির্বাচনের দায়িত্বে কর্মরত ছিলেন। ২০২৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তাদের মধ্যে সংঘর্ষে ৭ বছরের শিশু রোমিও ত্রিপুরা নিহত হয়। ১৮ জুন শান্তি পরিবহনের সুপারভাইজার নাইম ইসলাম ও এক অক্টোবর শিক্ষক আবুল হাসনাত মো. সোহেল রানাকে পিটিয়ে হত্যা করে উপজাতিয় সন্ত্রাসীরা। একই বছরের জুলাইয়ে গুলিবর্ষণে খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফ কমান্ডার জুনেল চাকমা, অক্টোবরে পানছড়িতে একাধিক কমান্ডার নিহত হয়। নভেম্বরে পানছড়িতে সংগঠক মিতন চাকমা নিহত হয়। 

২০২৪ সালের ১৯সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়িতে মোটর সাইকেল চালক মামুনকে হত্যার পর দীঘিনালা ও রাঙামাটিতে ইউপিডিএফ’র ইন্ধনে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৪জন নিহত হয়। 

২০২৫ সালের ১৬এপ্রিল ৫জন শিক্ষার্থীকে ইউপিডিএফ অপহরণ করে। সেনা অভিযানের পর মুক্তি দওেয়া হয়। 

সবশেষ ২৮ সেপ্টেম্বর গুইমারা খাগড়াছড়িতে পিসিপি-এর অতির্কিত হামলায় ১১জন সেনা সদস্য আহত হয়। একইদিনে ধর্ষণ ঘটনাকে পুঁজি করে সহিংস আন্দোলন শুরু হয়। যাতে ৩ জন নিহত ও আহত হয় ৩০ জন। এভাবে ২০০৯ সালের থেকে ১সেপ্টেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ১৬ বছরে ১৭৪ জনকে হত্যা, অপহরণ করা ৩৫০ জনকে।

এদিকে ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির বিরোধিতা করে পার্বত্য রাজনীতিতে জন্ম নেয় ইউপিডিএফ যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রসীত বিকাশ খীসা।এই নতুন রাজনৈতিক সংগঠনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন মাইকেল চাকমা। অপরদিকে,একই উপজাতি গোষ্ঠীর আরেক পরিচিত নেতা,শক্তিমান চাকমা,বেছে নেন ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ। এই দুই নেতার মধ্যে দ্বন্দ্ব তীব্র হয় ২০১১ সালের ০৮ ফেব্রুয়ারি। সেসময় চাঁদাবাজি, অস্ত্র, চোরাচালানসহ ১৮টি মামলার দায়ে পতেঙ্গা থেকে র‍্যাব অস্ত্রসহ মাইকেল চাকমাকে গ্রেফতার করে। এই গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে মাইকেল চাকমার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ একরকম ধূলিসাৎ হয়ে যায়। 

ওদিকে,এই সুযোগে রাজনীতিতে ক্রমশ মূল নেতা হিসেবে প্রকাশ পায় শক্তিমান চাকমা। তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তিনি নানিয়ারচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ক্ষমতার এই পটপরিবর্তন মাইকেল চাকমার মনে গভীর ক্ষোভ ও প্রতিহিংসার জন্ম দেয়। মাইকেল চাকমার নেতৃত্ব ফিরে পাওয়ার এবং ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার একমাত্র বাধা হয়ে দাঁড়ান শক্তিমান চাকমা। 

২০১৮ সালের ০৩মে সকালে উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমা  মটর সাইকেলে চড়ে অফিসের উদ্দেশে রওয়ানা হন। নানিয়ারচর উপজেলা কমপ্লেক্স গেইটের ভিতরে পৌছামাত্র ওৎপেতে থাকা সশস্ত্র সদস্যরা তার দিকে গুলি ছুড়ে। এই হামলার মাধ্যমে জনপ্রিয় উপজেলা চেয়ারম্যান শক্তিমান চাকমাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ড পুরো পার্বত্য অঞ্চলে গভীর আতঙ্ক ও অস্থিরতা তৈরি হয়। নৃশংসতার এখানেই শেষ ছিল না। হত্যাকাণ্ডের পরদিন, ৪মে তার শেষ কৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য তপন জ্যোতি বর্মাসহ ১২জনের দল খাগড়াছড়ি হতে নানিয়ারচর যাওয়ার পথে বেলা নানিয়ারচরের বেতছড়িতে রাস্তার পাশে ওৎপেতে থাকা সশস্ত্র সদস্যরা গুলি ছুড়ে। চালকের হাতে গুলি লাগা মাত্র মাইক্রোবাসটি রাস্তার সাইডে উল্টে পরে গেলে সশস্ত্র সদস্যরা কাছে এসে গুলি করলে তপন জ্যোতিসহ ৩জন ঘটনাস্থলে মারা যায়। 

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৯ মে শক্তিমান চাকমার বন্ধু ও সহকর্মী রূপস চাকমা বাদী হয়ে মাইকেল চাকমাসহ ৪৬জনের বিরুদ্ধে নানিয়ারচর থানায় মামলা করেন। একজন নেতা যখন নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে নিজ জাতির আরেক নেতা এবং নিজ দলের সহকর্মীদের হত্যা করতে পারে, তখন পার্বত্য অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।  

গোয়েন্দা সূত্র গুলো জানায়,এইসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, মাইকেল চাকমা আওয়ামী লীগ সরকারের সাথে মতবিরোধের ফলে গুমের শিকার হন। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ০৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তিনি ছাড়া পান।গুমের বিষয়কে পুজি করে দেশবাসীর সহমর্মিতাকে কাজে লাগিয়ে পুনরায় ইউপিডিএফ এর মাস্টারমাইন্ড হিসাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে নাশকতার পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে লিপ্ত রয়েছেন এবং বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া ও চ্যানেলে নিজেকে ভিকটিম হিসাবে উপস্থাপন করে সুকৌশলে ভারতীয় এজেন্ডা বাস্তবায়নে লিপ্ত হয়েছেন।খাগড়াছড়ি এবং গুইমারার ঘটনায় তার মিথ্যা বয়ান এবং আদিবাসী বিষয়ে উদ্দেশ্যমূলক বক্তব্য এই বিষয়টিকে প্রমাণ করে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অভিমত। 

এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর মো. এমদাদুল ইসলাম বললেন,পার্বত্য এলাকায় জাতিগত বিরোধের সুযোগ নিয়ে বাইরের শক্তির ইন্ধনের কারণে মাঝে মাঝে অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। তাই একাধিক হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের ঘটনা ঘটেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে এই ধরনের সশস্ত্র তৎপরতা মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সীমান্ত নজরদারি বৃদ্ধি, গোয়েন্দা সহযোগিতা এবং রাজনৈতিক স্তরে কার্যকর কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। 

বিভি/এআই

মন্তব্য করুন:

সর্বাধিক পঠিত
Drama Branding Details R2
Drama Branding Details R2