রুহিতার চরে বাঁচার লড়াই
কোলে শিশু, চোখে জল নিয়ে ডিসি কার্যালয়ে ভূমিহীন নারীরা
এক হাতে শিশু, অন্য হাতে ছেঁড়া কাপড়ের পুটলি। চোখজুড়ে আতঙ্ক, কণ্ঠে অসহায়ত্ব। বরগুনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই নারীটি কোনো রাজনৈতিক কর্মী নন তিনি একজন ভূমিহীন মা। বিষখালী নদীর ভাঙনে যাঁর সব হারিয়েছে, আর রুহিতার চরে যিনি নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
রবিবার বেলা ১১টায় বেতাগী উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন থেকে পাঁচ শতাধিক ভূমিহীন নারী-পুরুষ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। তাদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন নারী ও শিশু। কোলে শিশুসন্তান, পাশে স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়েকে নিয়ে তারা এসেছেন একটাই দাবি নিয়ে বাঁচার অধিকার।
এই নারীরা বলেন, নদীভাঙনে তাদের রেকর্ডীয় জমি বিষখালী নদীগর্ভে চলে যাওয়ার পর নদীর মাঝখানে গড়ে ওঠা রুহিতার চরেই তারা আশ্রয় নেন। সেখানে কুঁড়েঘর তুলে, ক্ষেতের মাটি আঁকড়ে ধরে কোনোভাবে জীবন চলছিল। শিশুদের মুখে হাসি ফিরছিল ধানের ক্ষেতে খেলতে খেলতে।
কিন্তু ২০২৪ সাল থেকে সেই শান্তিটুকুও ভেঙে যায়। অভিযোগ, বামনা উপজেলার চরসংলগ্ন এলাকার কিছু মানুষ তাদের চাষাবাদে বাধা দিতে শুরু করে। চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রশাসনের মাধ্যমে দুই উপজেলার সীমানা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে তার কোনো সুফল পাননি ভূমিহীনরা। বরং ধান কেটে নেওয়া, ক্ষেত নষ্ট করা এবং মামলা দিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা।
এক মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার বাচ্চাডার মুখের ভাত ওই ধান। ধান কাইটা নিলে আমরা কী খামু? আরেক নারী বলেন, মামলা দিলে পুরুষরা লুকায়া থাকে, আমরা মাইয়া আর বাচ্চারা নিয়া কী করমু?
অবস্থান কর্মসূচিতে তারা সীমানা নির্ধারণের কার্যকর বাস্তবায়ন ও হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান। পরে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া পাঁচজনকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। জেলা প্রশাসক দ্রুত সমাধানের আশ্বাস দিলে আন্দোলন সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করা হয়।
কিন্তু আন্দোলন চলাকালীনই ঘটে আরও হৃদয়বিদারক ঘটনা। ভূমিহীনদের অভিযোগ, তারা যখন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থানে ব্যস্ত, তখন রুহিতার চরে থাকা তাদের তিনটি বসতঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। আগুনে পুড়ে যায় শিশুদের বই, কাপড়, হাঁড়ি-পাতিল—সবকিছু। ঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে পড়ে যায় নারী ও শিশুরা।
এক শিশু ভয়ে মায়ের আঁচল চেপে ধরে বলে, আমাগো ঘর আর নাই? এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি কেউ।
রুহিতার চর আজ শুধু একটি ভৌগোলিক সীমানা নয়; এটি শত শত নারীর মাতৃত্ব, শিশুদের ভবিষ্যৎ আর পরিবারগুলোর শেষ আশ্রয়। সেই আশ্রয় যদি নিরাপদ না হয়, তবে নদীভাঙনে সর্বস্ব হারানো এই মানুষগুলো কোথায় যাবে এই মানবিক প্রশ্নই আজ প্রশাসন ও সমাজের সামনে দাঁড়িয়ে।
বিভি/এজেড




মন্তব্য করুন: