আসামি ছাড়াতে চুক্তির টাকা না পেয়ে ব্যবসায়ীর প্রাইভেটকার লুট!

চট্টগ্রামে থানা থেকে আসামি ছাড়ানোর জন্য চুক্তি অনুযায়ী টাকা না দেওয়ায় এক ব্যবসায়ীর প্রাইভেটকার হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। গত সোমবার (৬ অক্টোবর) ডবলমুরিং থানা এলাকায় এই ঘটনা ঘটে। বৃহস্পতিবার দুপুরে ‘মেট্রো স্কাই লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. হাসান চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন। এতে ৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
প্রধান অভিযুক্তরা হচ্ছেন- চট্টগ্রাম নগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইলিয়াস খান ও মীর কাশেম। গাড়ি ফেরত দেওয়ার জন্য তারা এখন ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছেন বলে জিডিতে উল্লেখ করা হয়েছে। বাদী আদালতে ২০০ ধারায় ঘটনার জবানবন্দিও দিয়েছেন।
জবানবন্দিতে বলা হয়, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকায় অবস্থিত কাদেরী চেম্বারে ‘মেট্রো স্কাই সিটি লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চুরির ঘটনা ঘটে। গত রবিবার বেলা ২টা থেকে আড়াইটার মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় থেকে নগদ সাড়ে ৮ লাখ টাকা, একটি ল্যাপটপ ও প্রাইভেটকারের কিছু কাগজপত্র চুরি হয়। পরের দিন সোমবার সকালে ডবলমুরিং থানায় অভিযোগ দাখিল করতে যান প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হামিদুল ইসলাম রিপন ও চট্টগ্রাম অফিসের ইনচার্জ মো. হাসানসহ কয়েকজন। তারা ডবলমুরিং থানার দায়িত্বরত এক কর্মকর্তাকে ঘটনার বর্ণনা দেন এবং মামলা করবেন বলে জানান। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলা নেওয়া হবে এবং ওইদিন রাতে তাদের থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেন। সোমবার রাত ১০টার দিকে হাসানসহ ওই প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন কর্মকর্তা ডবলমুরিং থানায় যান। এরপর প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মো. হাসানকে পুলিশ থানা হাজতে ঢুকিয়ে ফেলেন। এতে হতভম্ভ হয়ে পড়েন হাসান ও তার সঙ্গে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
তাকে হাজতে ঢোকানোর কারণ জানতে চাইলে পুলিশ বলে, ‘হাসান আওয়ামী লীগের দোসর। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলসহ কয়েকজনের সঙ্গে হাসানের ছবি আছে।’
এ সময় মেট্রো স্কাই লিমিটেডের গাড়িচালক মোরশেদ আলম আকবরশাহ থানা এলাকার ইলিয়াস খানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হাসানকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। এসময় গাড়িচালক মোরশেদ আলম অভিযোগ করেন, ইলিয়াস খান ডবলমুরিং থানায় এসে হাসানকে থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এবং এ জন্য তাকে ২ লাখ টাকা দিতে হবে বলে জানান। দরকষাকষির এক পর্যায়ে হাসানকে ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য ১ লাখ টাকা দাবি করেন ইলিয়াস।
এদিকে এরই মধ্যে মেট্রো স্কাই সিটি লিমিটেডের লোকজন পুলিশের সঙ্গে কথা বলে হাসানকে ছাড়িয়ে নেন। অন্যদিকে এ সময় ডবলমুরিং থানায় হাজির হন ইলিয়াস। হাসানকে ছাড়িয়ে নেওয়া বাবদ ২ লাখ টাকা দাবি করেন তিনি। কিন্তু মেট্রো স্কাইয়ের লোকজন বলেন, তারা অল্প টাকা দিয়ে হাসানকে পুলিশের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছেন। ইলিয়াসকে কোনো টাকা দিতে পারবেন না। টাকা না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ইলিয়াছ গাড়িচালক মোরশেদকে মারধর করেন। এরপর মীর কাশেম ও ইলিয়াছের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন মিলে চালকের কাছ থেকে মেট্রো স্কাই সিটির প্রাইভেটকারটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
সূত্র জানায়, সেই গাড়ি ফেরত চাইতে গেলে হাসানের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন তারা। গাড়ি না পেয়ে মেট্রো স্কাই সিটির পক্ষ থেকে মো. হাসান বৃহস্পতিবার দুপুরে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সাধারণ ডায়েরি করেন। ডায়েরিতে ইলিয়াস, মীর কাশেম, মোহন, মাহি, শরিফুদ্দিন জুয়েলসহ ৭ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
জিডিতে বলা হয়, ‘ডবলমুরিং এলাকা থেকে কৌশলে প্রাইভেটকারের চালক মোরশেদকে অপহরণ করে আকবরশাহ থানা এলাকায় গাড়িটি (চট্ট মেট্রো খ-১১-১৯২৯) নিয়ে যায়। গাড়িটি ফেরত চাইলে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন বিএনপি নেতা ইলিয়াস খান ও মীর কাশেম। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের কেটে টুকরো করার হুমকিও দেন তারা। থানা পুলিশ মামলা নিচ্ছে না। উলটো আমাদের ফাঁসিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।’
এদিকে মো. হাসান বাংলাভিশনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ডবলমুরিং থানা পুলিশ আসামিদের সাথে এক হয়ে আওয়ামী লীগের দোসর বলে আমাকে হাজতে ঢুকিয়ে দেয়। পরে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে মুক্ত হই। বিএনপি নেতারা আমাদের কোম্পানির টাকায় কেনা প্রাইভেটকারটি নিয়ে গেছে। গাড়ি ফেরত দেওয়ার বিপরীতে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করছেন।’
মেট্রো স্কাই সিটির চেয়ারম্যান হামিদুল ইসলাম রিপন বলেন, ‘মাত্র দেড় মাস চট্টগ্রামে মেট্রো স্কাই সিটির একটি শাখা অফিস নেওয়া হয়েছে। সেখানে মো. হাসানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কাসিমাতুন সুবাত মাহি নামের একটি মেয়েকে এডমিন এবং একাউন্টসের কাজের জন্য নিয়োগ দেয় হাসান। রবিবার (৫ অক্টোবর) বিকালে জরুরি কাজে হাসান বাইরে বের হলে মাহি অফিস থেকে ৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা, একটি ল্যাপটপ ও গাড়ির কাগজপত্র নিয়ে পালিয়ে যায়। বিষয়টি জেনে ওই দিন রাতে চট্টগ্রাম যাই। সোমবার সকালে হাসানকে সঙ্গে নিয়ে ডাবলমুরিং থানায় চুরির অভিযোগ করতে গেলে থানায় দায়িত্বরত কর্মকর্তা তাদেরকে সন্ধ্যার পর যেতে বলেন। সন্ধ্যার পর আবার থানায় গেলে হাসানকে মিথ্যা অভিযোগে আটক করে ডাবলমুরিং থানা পুলিশ। বিভিন্ন মাধ্যমে থানার ভারপ্রাপ্ত তদন্ত কর্মকর্তা বাবুল দেবনাথকে ফোন করালে তিনি ভুল স্বীকার করে মঙ্গলবার দুপুরের পর হাসানকে থানা থেকে ছেড়ে দেন। এরপর থেকে জুয়েল, মীর কাশেম ও ইলিয়াছসহ স্থানীয় কিছু যুবক বিএনপির নেতা পরিচয়ে চাঁদা দাবি করেন। চাঁদা দিতে অসম্মতি জানালে মাহির সহযোগিতায় অফিসের গাড়িটি ছিনতাই করে। এ নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নিলে তারা উল্টো হুমকি দিয়ে আসছে।’
বিষয়টি জানতে বাংলা ভিশনের প্রতিবেদক অভিযুক্ত ইলিয়াছকে ফোন করে এ বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাহি এবং মাহির স্বামীকে তিনি চেনেন। কিন্তু গাড়ি ছিনতাই ও চুরির বিষয়টির সাথে তিনি যুক্ত নন।
এদিকে, বিএনপি নেতা মীর কাশেমকে ফোন করে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গাড়ি ইলিয়াসের অফিসের আশপাশে আছে। গাড়ি ভাগাভাগির বিষয়ে মাহি, জুয়েল ও ইলিয়াস বৈঠকও করেছে তার অফিসে।’
উল্লেখ্য, অপরাধীদের শাস্তি এবং প্রাইভেটকার ও চুরি হওয়া টাকা উদ্ধারের দাবিতে মেট্রো স্কাই সিটির পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি মোড়ে একটি রেস্টুরেন্টে রবিবার (১২ অক্টোবর) সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: