সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আদায় হয়নি কঙ্ক্ষিত রাজস্ব

আমদানি-রফতানিতে ধীরগতির কারণে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শুল্ক স্থলবন্দর সোনামসজিদ স্থল বন্দরে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে আদায় হয়নি কঙ্ক্ষিত রাজস্ব। রয়েছে ২১৫ কোটি টাকা ঘাটতি। এর কারণ হিসেবে বিগত অর্থ বছরের শুরুতেই ছাত্র আন্দোলন ও সংগ্রামে দেশের অচলাবস্থা এবং বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে নেতিবাচক ব্যবসায়িক সম্পর্ককে দায়ী করছেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা। আর বর্তমান সরকারের আমদানি নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগের কারণে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে বলে দাবি কাস্টমস কর্মকর্তাদের।
সোনামসজিদ স্থল বন্দর কাস্টমস সূত্রে জানা যায়, গত অর্থ বছরে (২০২৪-২৫) চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ শুল্ক স্থলবন্দরে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে ২১৪ কোটি ৬১ লাখ ১২ হাজার টাকা। যেখানে ১ হাজার ১২২ কোটি ৪১ লক্ষ ৫৯ হাজার টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আয় হয়েছে ৯০৭ কোটি ৮০ লক্ষ ৪৭ হাজার টাকা। বিগত ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৯ দশমিক ১২ শতাংশ রাজস্ব কম আদায় হয়েছে। এর মধ্যে পুরো অর্থ বছরে শুধু মে মাসে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করতে পেরেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। বাকি ১১ মাসেই ছিলো ঘাটতির মধ্যে।
বন্দর সংশ্লিষ্টদের দাবি, বিগত অর্থ বছরের শুরুতেই জুলাই-আগস্টের আন্দোলন, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি, সরকার পতন, ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি এবং ফল, কৃষিপণ্য, পাথর ও অধিক শুল্কযুক্ত পণ্যের আমদানি কমার ফলে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে। এছাড়াও গত কয়েক বছর ধরে কমেছে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। ফলে টানা তিন বছর লক্ষ্যমাত্রা অর্জণ করা সম্ভব হয়নি।
আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা জানান, সোনামসজিদ স্থল বন্দর দিয়ে শূন্যের কোঠায় নেমেছে ফল আমদানি। এছাড়াও কমেছে কৃষিপণ্য, গোখাদ্য ও পাথর আমদানি। কারণ পুরো অর্থ বছর জুড়েই ছিল অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। এমনকি দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি, ডলার সংকটে চাহিদামতো পণ্যের চাহিদা দিতে না পারা, ব্যবসায়ীদের ভিসা না দেওয়া ও অবকাঠামোগত সমস্যায় সোনামসজিদ স্থলবন্দরে গতি কমেছে আমদানি-রফতানিতে। এমনকি অন্য পণ্য আমদানির পাশাপাশি পাথর আমদানিও বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে।
আমদানিকারক তরিকুল ইসলাম বলেন, গেলো বছর ডলার সংকট থাকায় এলসি করতে প্রচুর বেগ পেতে হয়েছে। এছাড়াও দুই দেশের সরকারের মধ্যে সম্পর্কের অবনতিতে ব্যবসা বাণিজ্য স্বাভাবিক ছিলো না। তবে ধীরে ধীরে সম্পর্ক স্বাভাবিক হচ্ছে। আশা করা যায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় গেলে আবারও আগের মতো গতি ফিরবে আমদানি-রফতানিতে।
কাস্টমস ও পানামার অসহযোগীতার কারণ উল্লেখ করে একজন সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বলেন, এখানকার কাস্টমসের পাশাপাশি পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেড ব্যবসায়ীদের প্রতিনিয়ত হয়রানি করেন। পানামার অবকাঠামোগত সমস্যা কারণে মালামাল নিয়ে এনে তা রোদ ঝড় বৃষ্টিতে কয়েকদিন ফেলে রেখে আনলোড করা হয়। এতে নষ্ট হয়ে যায় অনেক আমদানি পণ্য। আর তাই বর্তমানে শুধু পাথরের স্থল বন্দরে পরিণত হয়েছে সোনামসজিদ স্থল বন্দর। যেটা বাইরে পড়ে থাকলে ক্ষতির বা নষ্ট হবার কোন সুযোগ থাকে না। এছাড়াও সড়কের অবস্থা ভালো না হওয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যে ব্যাপক ধ্বস নেমেছে এই বন্দরে।
তিনি আরও বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের জন্য আহ্বান জানালেও তাতে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এছাড়াও সোনামসজিদ স্থলবন্দরে আমদানি রফতানীকারক গ্রুপ, সিঅ্যান্ডএফ, শ্রমিক সংগঠন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, পানামা পোর্ট লিংক লিমিটেডের একে অপরের সাথে কোনো সমন্বয় নেই। এছাড়াও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের এমপি নেতাদের প্রভাব বিস্তার ও চাঁদাবাজির কারণে সকল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বওে মুখ থুবড়ে পড়েছে সোনামসজিদ স্থলবন্দর।
আমদানিকারক মো. আরিফুর রহমান বলেন, ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো আমদানিকারকদের ঠিকমতো এলসি দিতে পারেনি। বিশেষ করে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ছাড়া যেসব পণ্যের ওপর অধিক শুল্ক রয়েছে এমন পণ্যের কোনো এলসি দিতে পারেনি ব্যাংক। যার কারণে ওসব পণ্য বন্দর দিয়ে তেমন একটা আমদানি হয়নি। যার কারণে বন্দর থেকে রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
তবে তাদের ওপর আরোপিত অভিযোগ অস্বীকার করে সোনামসজিদ স্থলবন্দর কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. নূরুল হাসান জানান, আলু, পেঁয়াজ ও গুড়সহ কৃষিপণ্য না আসা এই বন্দরের রাজস্ব ঘাটতির অন্যতম কারণ। এছাড়াও রাজস্ব আদায় বেশি হওয়া মানে আমাদের দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা চলে যাওয়া। চলতি বছর দেশে বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজ, আলুসহ নিত্যপণ্যের দাম নাগালের মধ্যে ছিলো। ফলে তা আমদানির প্রয়োজন পড়েনি। আর এতেই রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে।
প্রসঙ্গত, সোনামসজিদ স্থলবন্দরে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ১৬৩ কোটি ৬৭ লক্ষ টাকা এবং ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৪১৮ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা রাজস্ব ঘাটতি হয়েছিলো।
বিভি/এআই
মন্তব্য করুন: