শেয়ার কারসাজিতে হিরোর জরিমানা, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে মোহাম্মদ ইউনুছ

পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এনআরবিসি ব্যাংক লিমিটেডের শেয়ার নিয়ে কারসাজির কারণে কনিকা আফরোজ এন্ড এসোসিয়েটসের শাস্তি হলেও এ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্যদের ব্যাপারে নমনীয়তা দেখিয়েছে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। ডিআইটি কো-অপারেটিভ এর আবুল খায়ের হিরোর জরিমানা হলেও এই কারসাজিতে শাহজালাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছকে কোনো জরিমানা করা হয়নি।
শেয়ার ক্রেতাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন, শাহজালাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছ। মোহাম্মদ ইউনুছ এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার ২০ দিনের ব্যবধানে ( ৫ মে-২৪ মে২০২১) মোট লেনদেনের ৫ দশমিক ৪২ শতাংশ লেনদেন করেছেন।
এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে (৫ মে-২৪ মে২০২১) ১২ টাকা ৪০ পয়সা থেকে ৩৩ টাকা ৮০ পয়সায় লেনদেন হয়। এ সময়ে ব্যাংকটির শেয়ার দর বেড়েছে ১৭২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তদন্তে বেরিয়ে আসে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় ডিআইটি কো-অপারেটিভ লিমিটেডের স্টক ব্রোকারেজের ক্লায়েন্ট কোড ৭০২২ থেকে সবচেয়ে বেশি শেয়ার বাই সেল হয়েছে। এই বিও হিসাব পরিচালনার অথোরাইজড ব্যক্তি শেয়ারবাজারের আলোচিত-সমালোচিত আবুল খায়ের হিরো। আলোচিত সময়ে এ একাউন্ট থেকে এক কোটি ৪০ লাখ ৬৮ হাজার ৭৮৭টি শেয়ার কেনা হয় এবং বিক্রি করা হয় এক কোটি ২০ লাখ ৯৭ হাজার ২৩১টি শেয়ার। ৫ মে থেকে ২৪ মে ২০২১ পর্যন্ত সময়ে এনআরবিসি ব্যাংকের মোট লেনদেনের ১৪.২২ শতাংশ।
এ তালিকার দ্বিতীয় স্থানে আছে কাজী সাদিয়া হাসানের নাম। তিনি আবুল খায়ের হিরোর স্ত্রী। ইউসিবি স্টক ব্রোকারেজ লিমিটেডের ৩৮৯৮ কোড থেকে আলোচিত সময়ে এনআরবিসি ব্যাংকের ১ কোটি ১ লাখ ১৯ হাজার ৩৬৮টি শেয়ার কেনা হয় এবং ৬৮ লাখ ৮০ হাজার ৬৪২টি শেয়ার বিক্রি করা হয়। যা মোট লেনদেনের ৯.২৪ শতাংশ।
এ তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছে মোহাম্মদ ইউনুছের নাম। ইবিএল সিবিউরিটিজ লিমিটেডের ৪৫০৬৪ ক্লায়েন্ট কোড থেকে ৪৯ লাখ ৮৮ হাজার ৫৯৪টি শেয়ার কেনাবেচো করা হয়। যা উক্ত সময়ে ব্যাংকটির কারসাজি করাকালীন সময়ের মোট লেনদেনের ৫.৪২ শতাংশ।
প্রসঙ্গত চলতি বছরের ৬ জুলাই পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি ৫ মে-২৪ মে ২০২১ পর্যন্ত সময়ে এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজির জন্য কনিকা আফরোজ এন্ড এসোসিয়েটসকে ৩ কোটি ৭৫ লাখ জরিমানা করে। উল্লেখ্য কনিকা আফরোজ আবুল খায়ের হিরো’র বোন। তবে এই কারসাজিতে মোহাম্মদ ইউনুছের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নয়নি বিএসইসি।
এবিষয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এই বিষয়টি নিয়ে আমি এখন সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য দিতে পারবো না। তবে আপনি যদি বিস্তারিত জানতে চান তাহলে কমিশনে আসুন।’ এ সময় প্রতিবেদকের কাছে তিনি জানতে চান মোহাম্মদ ইউনুছ সাহেব কি পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন। জবাবে প্রতিবেদক তার শেয়ারের পরিমাণ জানালে তিনি বলেন, ‘তাই নাকি!’
পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির কাছে গত এক বছরে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণসহ অন্তত ২০টি পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)। এর বাইরে পাঠিয়েছে শতাধিক নিয়মিত সার্ভেল্যান্স প্রতিবেদন। একের পর এক তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরও হিরোর কারসাজি বন্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তবে লোক দেখানো ফরচুন সুজ ও এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজিতে আবুল খায়ের হিরো ও তার পরিবারের সদস্যদেরকে ৫ কোটি ২৫ লাখ টাকা জরিমানা করেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
এই কারসাজিতে আবুল খায়ের হিরো, তার বাবা আবুল কালাম মাতবর, স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বোন কনিকা আফরোজ, শ্যালক কাজী ফরিদ হাসান ও তার কোম্পানি ডিআইটি কো-অপারেটিভ জড়িত। তারা ফরচুন সুজ কারসাজিতে রিয়েলাইজড ৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা এবং আনরিয়েলাইজড ২৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা মুনাফা করেছে বলে ডিএসইর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
অন্যদিকে এনআরবিসি ব্যাংকের শেয়ার কারসাজিতে রিয়েলাইজড ১৫ কোটি ২২ লাখ টাকা এবং আনরিয়েলাইজড ২৩ কোটি ৩৩ লাখ টাকা মুনাফা করেছে বলে ডিএসইর প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। ডিএসই হিরো ও তার পরিবারের সম্পৃক্ততায় ওই কোম্পানি দুটির শেয়ার কারসাজিতে ৯৪.৬৭ শতাংশ দর বৃদ্ধি দেখতে পায়। যা ২০২১ সালের ২০ মে থেকে ১৭ জুন এক তদন্তে পাওয়া যায়।
এর আগে হিরো ও তার সহযোগীদের গ্রীন ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স ও এশিয়া ইন্স্যুরেন্সের কারসাজিতে ২ কোটি ৯ লাখ টাকা জরিমানা করে কমিশন।
এনআরবিসির শেয়ার ক্রয়ে অনিয়মের অভিযোগে হিরোকে জরিমানা করা হলেও কেন শাহজালাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুছের বিরুদ্ধে কেন কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি বিএসইসি জানতে চাইলে বিএসইসির কমিশনার অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘এটা আমাদের ল' এনফোর্সমেন্ট বিভাগের কমিশনার ভালো বলতে পারবেন।এ নিয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’
বিষয়টি নিয়ে বিএসইসির ল' এনফোর্সমেন্ট বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা বিষয়টি নিয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হয়নি।
বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. রেজাউল করিম বলেন, 'এ বিষয়ে বিশেষ অডিট চলছে, শাহজালাল ব্যাংকের চেয়ারম্যানের যদি আইনের ব্যত্যয় করে থাকলে তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'
বিভি/এনএ
মন্তব্য করুন: