গকসু নির্বাচনে নারীর কণ্ঠস্বর: সাহস, সমতা ও সম্ভাবনার গল্প

গণ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচন ২০২৫–এর ভোটগ্রহণ আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর। দীর্ঘ সাত বছর পর আয়োজিত এ নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে। এবারের আলোচনায় রয়েছেন একঝাঁক তরুণী প্রার্থী, যারা শুধু নারী প্রতিনিধিই নন, বরং ক্যাম্পাসে পরিবর্তন ও সমতার বার্তাবাহক হয়ে উঠেছেন।
গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ৪,৭৬১ ভোটারের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গকসু নির্বাচন। প্রার্থীদের প্রচারণায় এখন সরব পুরো ক্যাম্পাস। তবে আলোচনায় এগিয়ে রয়েছেন নারী প্রার্থীরাও। সাধারণ সম্পাদক, সম্পাদকীয় ও কার্যনির্বাহী সদস্য পদে তাদের পদচারণা শিক্ষার্থীদের মনে নতুন প্রত্যাশা জাগিয়েছে।
গকসুর সূচনা ২০১৩ সালে। সেই প্রথম সংসদেই নারী নেতৃত্ব দৃশ্যমান হয়। তখন সহ-সাহিত্য ও ম্যাগাজিন সম্পাদক পদে ছিলেন জিনাত রেহানা (মেডিকেল ফিজিক্স এন্ড বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং), নাট্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ছিলেন হাফিজা খান লীনা (আইন), সহ-নাট্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ছিলেন সাদিয়া হালিম (রাজনীতি ও প্রশাসন), সেমিনার ও বিতর্ক সম্পাদক ছিলেন মাহমুদা বেগম (ইংরেজি) এবং সহ-সেমিনার ও বিতর্ক সম্পাদক ছিলেন লিনা নার্গিস (এমবিবিএস)। সেবার ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন এমবিবিএস ব্যাচের মিশু।
দ্বিতীয় সংসদে (২০১৫) আলোচনায় আসেন আইন বিভাগের কণিকা। তিনি ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। একই নির্বাচনে কোষাধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত হন ইফফাত ফারহা মৌসুমী এবং নুসরাত জাহান টুম্পা (এমবিবিএস) নির্বাচিত হন সহ ক্রীড়া সম্পাদক (Indoor Games) পদে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে ফার্মেসির খাদিজাতুত তাহিয়া সেতু নির্বাচিত হন কোষাধ্যক্ষ। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, গকসু নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ বরাবরই উজ্জ্বল। এবারের নির্বাচনে সেই ধারাবাহিকতা আরও সুস্পষ্ট।
“নারী হয়েও আমি শুধু মেয়েদের প্রতিনিধি নই”
আফসানা মিমি, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী
“আমি নারী হয়েও শুধু মেয়েদের প্রতিনিধি নই, বরং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার সমস্যার কথা শুনতে চাই। অনেক সময় জিএস-এ মেয়েদের প্রার্থী দেখা যায় না। এবার যখন দেখলাম কোনো মেয়ে আসছে না, তখনই আমি মনোনয়ন তুললাম। আমি চাই আমার আপুরা জানুক, আমরা চুপ করে বসে থাকার জন্য নই।”
তার অগ্রাধিকার: লাইব্রেরি ও ল্যাব উন্নয়ন, সিসিটিভি ও নিরাপত্তা, র্যাগিংবিরোধী জিরো টলারেন্স, সাংস্কৃতিক ক্লাব শক্তিশালীকরণ, ক্যারিয়ার গাইডলাইন ও নেতৃত্ব প্রশিক্ষণ।
“নারী নেতৃত্ব মানে সমতা ও সহযোগিতা”
শারমিন আক্তার, দপ্তর সম্পাদক পদপ্রার্থী
“আমি চাই ছাত্র সংসদকে আরও স্বচ্ছ, সক্রিয় ও শিক্ষার্থীবান্ধব করতে। নারী নেতৃত্ব এলে সিদ্ধান্তে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি আসে। দায়িত্বশীলতা বাড়ে। শিক্ষার্থীদের ফিডব্যাক ও কল্যাণমূলক কাজে আমি সবসময় সক্রিয় থাকব।”
“সাহিত্য-সংস্কৃতিতে বৈচিত্র্যের প্রতিনিধি”
লীশা চাকমা, সহ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদপ্রার্থী
“আমি চাই সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সৃজনশীলতা ও বৈচিত্র্য উজ্জীবিত হোক। চাকমা জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে আমি এই বৈচিত্র্যকে সামনে আনতে চাই। নারী হিসেবে অনেক বাধা আসে, কিন্তু আমি প্রমাণ করতে চাই—নেতৃত্ব নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমান যোগ্যতার।”
তার অগ্রাধিকার: নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো, নতুন সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা, সংখ্যালঘু ও আদিবাসী সংস্কৃতি তুলে ধরা।
“নারী নেতৃত্বের নতুন অধ্যায় শুরু হবে”
মেঘলা আক্তার, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক পদপ্রার্থী
“গণ বিশ্ববিদ্যালয় নারী শিক্ষার্থীদের সুযোগ দিয়েছে, তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেনামি হয়রানি এখনো বড় সমস্যা। আমি চাই ইতিবাচক প্রচারণা, শিক্ষার্থীদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে। নারী নেতৃত্বে নতুন অধ্যায় শুরু হবে, এটাই আমার বিশ্বাস।”
সম্পাদকীয় পদের বাইরেও কার্যনির্বাহী সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন একাধিক তরুণী। তাদের মধ্যে রয়েছেন: মিনতুজ আক্তার মিম (আইন), খুরশিদ জাহান (ইইই), মেহেরুন খিলজী মিতু (সিএসই), সানজিদা আক্তার জেবা (কৃষি), সারফুন নাহার স্বর্ণা (ফলিত গণিত), নাশরুন সেঁজুতি অরণি (মাইক্রোবায়োলজি)।
নারী প্রার্থীরা বলছেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো: নেতৃত্বকে এখনো অনেকের কাছে পুরুষকেন্দ্রিক ধরা হয়, অনলাইন ও সরাসরি বিদ্রুপ-সমালোচনা, বেনামি হয়রানি, রাতের প্রচারণায় পারিবারিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতা, প্রচারণার অর্থ ও টিম গঠনে সমস্যা। তবুও তারা এগিয়ে এসেছেন- আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার সাথে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক নূর-ই তাহরিমা বলেন, “এবারের নির্বাচনে নারী প্রার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাত্ররাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত। যদিও সামাজিক ও অনলাইন হয়রানির মতো প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে, তারা আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগোচ্ছে এবং সহপাঠীরাও পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, নারী নেতৃত্ব নিরাপত্তা, স্যানিটেশন, যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও মানসিক স্বাস্থ্যসহ উপেক্ষিত বিষয়গুলোকে সামনে নিয়ে আসবে। এতে কার্যক্রম আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক হবে।”
বিভি/এজেড
মন্তব্য করুন: