আগের গকসুর কাজ কতোদূর, এবারকার প্রার্থীরা কতোটা এগিয়ে নেবে?

প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি, কিন্তু বাস্তবায়নের ঘাটতি- এটিই গণ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচনের দীর্ঘ ইতিহাসের সারসংক্ষেপ। ২৬ বছর ধরে গকসু শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার মঞ্চ হয়ে থাকলেও প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ফারাক নিয়েই হতাশা বেশি। তবুও নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের আগ মুহূর্তে আবারও বুক ভরা আশায় প্রার্থীদের প্রতিশ্রুতির ঝাঁপি ঘিরে সরব হয়ে উঠেছে পুরো ক্যাম্পাস।
আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে গকসু নির্বাচন। মোট ভোটার সংখ্যা ৪ হাজার ৭৬১ জন। রিটার্নিং অফিসের তথ্য অনুযায়ী, এবারে প্রার্থী হয়েছেন ৫৭ জন। ১৪ সেপ্টেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকা প্রকাশের পর থেকেই শুরু হয়েছে রঙিন প্রচারণা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, লিফলেট সবখানেই শোনা যাচ্ছে প্রতিশ্রুতির সুর।
এবারকার ইশতেহারগুলোর তালিকা দীর্ঘ। আবাসন সংকট নিরসন, ক্যান্টিনে ভর্তুকি, মানসম্মত খাবার নিশ্চিতকরণ, আধুনিক অবকাঠামো নির্মাণ, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, গবেষণা তহবিল, নিয়মিত নির্বাচন আয়োজন, ক্যারিয়ার ভিত্তিক জব ফেয়ার - সবই জায়গা করে নিয়েছে প্রার্থীদের ঘোষণায়।
অনেকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ‘One Bed, One Table, One Chair’ নীতিতে আবাসিক হল নির্মাণ, আধুনিক টিএসসি ও অডিটোরিয়াম, স্বাস্থ্যবিমা, এমনকি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একাডেমিক চুক্তি করে উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টির। নারী শিক্ষার্থীদের জন্য এসেছে বিশেষ প্রতিশ্রুতি - মাতৃত্বকালীন একাডেমিক সুবিধা, প্রতিটি বিভাগে রিডিং রুম ও কমন রুম, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র, পর্যাপ্ত লিফট, সাংস্কৃতিক বিকাশে মুক্তমঞ্চ নির্মাণ। পাশাপাশি অভিযোগ-পরামর্শ বক্স, বাজেট স্বচ্ছতা, ব্লাডব্যাংক, গবেষণা ও সৃজনশীল ক্লাব প্রতিষ্ঠা, ফ্রিল্যান্সিং ও আইএলটিএস প্রশিক্ষণ কোর্স চালুর আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।
অতীতের দিকে তাকালে দেখা যায়, গকসু ছিলো শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার মঞ্চ। তবে প্রতিশ্রুতি আর বাস্তবায়নের ফারাক শিক্ষার্থীদের হতাশ করেছে বারবার।
সাবেক ভিপি (২০১৫–১৭) মো. শামীম হোসেন বলেন, ‘আমাদের সময়ে ভোট হয়েছিলো শান্তিপূর্ণভাবে। আমরা ছাত্র সংসদের স্থায়ী কক্ষ তৈরি করেছি একইসাথে ইনডোর গেমস, জিমনেসিয়াম, টেনিস বোর্ড, বাস্কেটবল কোর্টের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সুইমিং পুলের জন্যও আবেদন করেছিলাম, যদিও প্রশাসন বিদ্যমান পুকুর ব্যবহারের কথা বলে। জরিমানা বা মাতৃত্বকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলোও তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। পাশাপাশি পিঠা উৎসব, বৈশাখী মেলা ও জাতীয় দিবসগুলো পালন করেছি। আশা করি নতুন নেতৃত্ব সবাই মিলে কাজ করবে, জয়-পরাজয়কে পেছনে ফেলে ঐক্যবদ্ধ থাকবে।’
সাবেক সাধারণ সম্পাদক (২০১৮–২০) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রাখতে না পারা শিক্ষার্থীদের আস্থার জায়গা নষ্ট করে। আমি তাই ইশতেহার দিইনি। তবে আমরা জিমনেসিয়াম করেছি, সেমিস্টার ফি-সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করেছি। করোনা এসে অনেক কিছু আটকে যায়। নতুন নেতৃত্ব যেন শিক্ষার্থীদের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানে মনোযোগ দেয়, সেটাই প্রত্যাশা।’
সাবেক ভিপি (২০১৮–২০) জুয়েল রানা মনে করেন, আমাদের সংসদ সেমিস্টার ফি ও জরিমানা মওকুফ করেছে, শিক্ষার্থীদের আর্থিক সমস্যায় কাজ করেছে। বিবিএ, ফিজিওথেরাপি, এমবিবিএসসহ চার বিভাগের অনুমোদন আনতে কাজ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় ও গণস্বাস্থ্যের বৈধ জায়গা রক্ষায় ভূমিকা রেখেছি। দুর্যোগকালে অসহায়দের পাশে থেকেছি, ক্যাম্পাস সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছি, নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছি।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা যে প্রত্যাশা নিয়ে আমাকে নির্বাচিত করেছিল তা পূরণ করতে পারিনি। নতুন নেতৃত্ব যেন শিক্ষার্থীদের হয়ে কাজ করে, প্রশাসনের দুর্নীতি দূর করে ছাত্র সংসদকে প্রকৃত অর্থে অধিকার আদায়ের প্ল্যাটফর্মে পরিণত করে এই প্রত্যাশা।’
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইন্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মো. রাশেদ বলেন, ‘২০১৮-২০ মেয়েদের গকসু খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের অনেক সুযোগ দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু ওয়ার্ল্ডকাপ ম্যাচে গবিকে তুলে ধরতে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। তবে খাবারের মান উন্নয়নসহ কিছু বিষয়ে ফাঁক থেকে গিয়েছিল, বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক কাজ করা যায়নি। তবুও তারা চেষ্টা করেছিল, শিক্ষার্থীদের পাশে থেকেছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তাদের বড় দুর্বলতা ছিলো ভিসি নিয়োগের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন এবং সংসদের ভেতরের কিছু দুর্নীতি, যা তারা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এবারের প্রার্থীদের মধ্যে যারা শিক্ষার্থীদের সমস্যা বুঝে প্রশাসনের সামনে তুলে ধরতে পারবে এবং নিরাপত্তা, যাতায়াত, ক্যাম্পাসের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করবে, তাদেরই অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। নতুন নেতৃত্বকে ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে শিক্ষার্থীদের জন্য স্বচ্ছভাবে কাজ করতে হবে।’
শিক্ষার্থীদের দাবি বরাবরই একই বাস্তবায়ন। আবাসন সংকট, ক্যান্টিনে নিম্ন মানের খাবার, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও ল্যাবরেটরির অভাব, স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি এসব সমস্যার সমাধান শিক্ষার্থীরা বহুদিন ধরে চাইছেন।
কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী তাসনিম বিনতে কালাম বলেন, ‘আগের গকসুর কর্মকাণ্ডে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। এবারের প্রতিশ্রুতির মধ্যে সবচেয়ে জরুরি হলো পরিবহন সমস্যা সমাধান, শ্রেণিকক্ষ ও ল্যাবের সংকট দূর করা এবং মানসম্মত ক্যান্টিন নিশ্চিত করা। এগুলো সম্ভব, তবে দরকার স্বচ্ছ নেতৃত্ব, প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ। আমরা চাই নেতৃত্ব হোক সাহসী, সৎ, পক্ষপাতহীন ও জবাবদিহিমূলক।’
রসায়ন বিভাগের শিক্ষার্থী আসিফ খান বলেন, ‘আগের গকসুর কর্মকাণ্ডে সমন্বয় ও সময় ব্যবস্থাপনার অভাবে অনেক কাজ অসমাপ্ত থেকেছে। এবারের প্রার্থীদের সবচেয়ে জরুরি প্রতিশ্রুতি হওয়া উচিত স্বচ্ছতা ও নীতিবোধ নিশ্চিত করা। বাস্তবায়ন সম্ভব, যদি প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংলাপ হয়। আমরা চাই নেতৃত্ব হোক সাহসী, সৎ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। প্রতিশ্রুতি দেওয়া সহজ, কিন্তু বাস্তবায়নই আসল চ্যালেঞ্জ এটা বুঝতে হবে।’
গণ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (গকসু) নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন রিদুয়ানুল ইসলাম মানিক। তিনি জানিয়েছেন, ‘অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন নেতৃত্বকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। মানিক জানিয়েছেন, নিয়মিত সভা, খোলা আলোচনার পরিবেশ এবং সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা করবেন। তিনি প্রশাসনের কাছে যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে চান। পাশাপাশি ছাত্রী হল নির্মাণ দ্রুত শেষ করার উদ্যোগ নেবেন এবং শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ সেল গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।’
সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন নাসিম খান। তিনি বলেছেন, ‘অতীতের ব্যর্থতার মূল কারণ ছিল ফলো-আপ ও সমন্বয়ের ঘাটতি। তাই প্রতিটি প্রতিশ্রুতির জন্য আলাদা অ্যাকশন প্ল্যান, সময়সীমা ও দায়িত্বশীল টিম গঠন করা হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য মাসিক অগ্রগতি রিপোর্ট প্রকাশ এবং প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার কথাও জানিয়েছেন। নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার জন্য ২৪ ঘণ্টা সিসিটিভি ও টহল, হেল্পলাইন ও কমপ্লেইন সেল চালু করা হবে। বাজেটের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে বাজেট তৈরি, মাসিক আয়-ব্যয় প্রকাশ ও স্বাধীন অডিট টিম গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।’
বিভি/এআই
মন্তব্য করুন: