‘সাত কলেজের খাতা’ ফেসবুকে ভাইরাল, সমালোচনার ঝড়
রাজধানীর সরকারি সাত কলেজের অনার্স ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষার খাতা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর ফেসবুক স্টোরিতে প্রকাশ পাওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তীব্র সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সোমবার (০৩ নভেম্বর) দিবাগত ২টার দিকে ফেসবুকে “jackpot” ক্যাপশন দিয়ে ছবিটি পোস্ট করা হয়।
জানা গেছে, ঘটনাটি ঘটে অনার্স ১ম বর্ষ (২০২৩–২৪) সেশনের ব্যবস্থাপনা বিভাগের খাতা ঘিরে। ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রুবাইয়া তাসনিম পরমা তার ফেসবুক স্টোরিতে সাত কলেজের খাতার একটি ছবি পোস্ট করেন। পোস্টটি দ্রুত ভাইরাল হয়ে যায়। এই ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা। রুবাইয়া তাসনিম পরমা ঢাকা কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক শিক্ষকের নাতনি বলে জানা গেছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে শিক্ষার্থীরা বলেন, "অনার্স ১ম বর্ষ (২০২৩–২৪) সেশনের ব্যবস্থাপনা বিভাগের খাতা ইস্ট-ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর হাতে কীভাবে গেল? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এটি শুধু একটি ‘খাতা ফাঁস’ নয়, এটি শিক্ষার্থীদের পরিশ্রম এবং ফলাফল প্রক্রিয়ার নিরাপত্তার প্রতি সরাসরি আঘাত বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।
সাত কলেজে প্রতি বছর গণহারে ফেল করানো হয়। এখন বুঝা যাচ্ছে এর পেছনে কী ধরনের অনিয়ম চলে। অনেক শিক্ষক ইচ্ছাকৃতভাবে শিক্ষার্থীদের ফেল করিয়ে খাতা ‘ইমপ্রুভ’-এর নামে অর্থ আদায় করেন। শিক্ষা এখন নৈতিকতার নয়, বাণিজ্যের অংশ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন তারা।
এই ঘটনার দায় কোনোভাবেই ছোট করে দেখা যাবে না।খাতাগুলো কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমা অতিক্রম করে বাইরে গেল? বিষয়টির সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান শিক্ষার্থীরা।"
মরিয়ম সুলতানা মারিয়া নামের এক শিক্ষার্থী বলেন, “এভাবেই অবহেলায় আর অমর্যাদায় শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলছেন তারা। ভালো লেখার পরও সিজিপিএ ভালো আসে না, এখন বুঝতে পারছি কেন।”
ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী শাহজালাল শুভ নিজের ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “আমি ঐতিহ্যবাহী সাত কলেজে পড়ি, যেখানে শিক্ষার্থীদের জীবনের কোনো দাম নেই, মেধারও মূল্য নেই। যেখানে আমরা আশা নিয়ে ভর্তি হই, বের হই হতাশা নিয়ে।”
শিক্ষকদের ব্যর্থতা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ইলিয়াস স্যার যে বললো আমাদের খাতা কেন্দ্র থেকে বন্টন হবে, খাতা দেখবে আমাদের শিক্ষকরা ঢাবি খাতা পাবে না। তাহলে কি ভাবে এই মেয়ে খাতা পেলো? যদি সে আমাদের কোন শিক্ষকের মেয়ে হয়েও থাকে তার কোন রাইটস নাই এ ভাবে অনার্সের খাতা স্টরি দেওয়া!
কি পেলাম আমরা ২৩-২৪ সেশন?? আশ্বাসের নামে আমাদের গলা টিপে ধরা ছাড়া কি করছে ইলিয়াস স্যার?
বিতর্কের মুখে পরমা তার ফেইসবুক স্টোরিতে জানান, কিছু শেয়ার করার আগে ভালো করে জানুন, বিভ্রান্তি ছড়াবেন না। আমার নানা সাত কলেজের শিক্ষক, তিনি খাতা দেখবেন।
এবিষয়ে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ কে এম ইলিয়াস বলেন, যে এই কাজটি করেছে, সে নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ করেনি। কারণ গোপন নথি প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই। এ ধরনের ঘটনা আমাদের কারও জন্যই শুভকর নয়। যতক্ষণ ফলাফল প্রকাশিত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত খাতা ডিসক্লোজারে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। ফলাফল প্রকাশের পরই তা ডিসক্লোজারে যায়। এখানে যার দায়বদ্ধতা রয়েছে, তাকে অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। এই ঘটনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাবে উল্লেখ তিনি আরও বলেন, যেহেতু ওই শিক্ষার্থী নিজেই বলেছে কার কাছ থেকে খাতা পেয়েছে, সেই সূত্র ধরে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাবো।
এবিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক হিমাদ্রী শেখর চক্রবর্তী বলেন, “আমরা ফেসবুকে বিষয়টি দেখার পর থেকেই খোঁজখবর নিচ্ছি। ঘটনার পর যার খাতা থেকে বিষয়টি এসেছে, সেই শিক্ষক নিজে এসে জানিয়েছেন যে খাতাটি তার এক আত্মীয়—নাতনির—হাতে গিয়েছিল। ওই ছাত্রী মজা করে খাতার ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয়। এখন যেহেতু বিষয়টি সামাজিক মাধ্যমে চলে এসেছে, আমি তাকে পরামর্শ দিয়েছি যেন ফেসবুকে সত্য ঘটনা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করে। কারণ না জানলে সবাই ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করবে, এতে বিভ্রান্তি তৈরি হবে।”
তিনি আরও বলেন, “ ওই শিক্ষকের কাছ থেকে খাতাটি ফেরত নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করা হবে। ঢাকা কলেজের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের ওই শিক্ষকই খাতাটি মূল্যায়ন করছিলেন। খাতা ফেরতের পর লিখিতভাবে বিষয়টি নথিবদ্ধ হবে, তখন বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে।”
শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি নতুন দায়িত্বে এসেছি, আগের অভিযোগ সম্পর্কে নিশ্চিত নই। যাদের কাছে খাতা মূল্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাদের নির্দেশনা দেওয়া থাকে, যে কোনো অসঙ্গতি বা অনিয়ম চোখে পড়লে তা সঙ্গে সঙ্গে জানাতে হবে।”
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত বাতিল করে রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজ নিয়ে নতুন একটি বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রস্তাবিত এ নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ‘ঢাকা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়’ নির্ধারণ করেছে। তবে (২০২৩–২৪) শিক্ষাবর্ষের পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
বিভি/এজেড




মন্তব্য করুন: