• NEWS PORTAL

  • রবিবার, ০৫ মে ২০২৪

Inhouse Drama Promotion
Inhouse Drama Promotion

জাল সনদে চাকরি করছেন কয়েক হাজার শিক্ষক, সরকারের গচ্চা তিনশ’ কোটি

প্রকাশিত: ১৮:১১, ১০ অক্টোবর ২০২২

আপডেট: ২৩:৩৩, ১০ অক্টোবর ২০২২

ফন্ট সাইজ

নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার গফুরাবাদ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়। ২০২০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর স্কুলটিতে অবৈধ নিয়োগের বিষয়ে তদন্ত করে। সে বছরের ৩১ ডিসেম্বর পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর পরিচালক প্রফেসর অলিউল্লাহ মোঃ আজমতগীর একটি প্রতিবেদন জমা দেন।

তাতে স্কুলটির একাধিক শিক্ষকের নিয়োগ অবৈধ বলে উল্লেখ করেন। তিনি অভিযুক্ত শিক্ষকদের বেতন ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধাদি সরকারি কোষাগারে ফেতরের প্রস্তাবও করেন। 

এ বিষয়ে অভিযুক্ত শিক্ষরা ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হয়নি। তবে অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে একজন শিক্ষক দাবি করেন, সকল নিয়ম কানুন মেনেই নিয়োগ হয়েছে এবং বিধিঅনুযায়ী বেতনসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধা করা ভোগ করছেন। তারা উল্টো পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে হয়রানির অভিযোগ করেন। 

স্কুলের মতো অনেক কলেজেও অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ রয়েছে। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার বঙ্গবন্ধু মহিলা ডিগ্রি কলেজ। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অলিউল্লাহ মোঃ আজমতগীর স্বাক্ষরিত ২১ আগস্ট, ২০২২ সালের একটি নিরীক্ষা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়,  কলেজটির ইতিহাসের প্রভাষক দিল আফরোজ শারমিন এর এনটিআরসিএ এবং প্রদর্শক শাহিনুর পারভীন এর কম্পিউটার বিষয়ে সনদ জাল। এ ক্ষেত্রেও অভিযুক্তদের বেতনভাতাসহ যাবতীয় সুবিধাদি সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুপারিশ করা হয় । গুরুতর এই অভযোগের বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষ মো. মোস্তাফিজুল হক বক্তব্য অভিযু্ক্তদের পক্ষেই। বাংলাভিশনকে তিনি বলেন, শাহিনুর পারভিন, প্রভাষক সেক্রেটারিয়াল সাইন্স, আমার জানামতে তার সকল সনদ বৈধ দিল আফরোজ শারমিন, প্রভাষক, ইতিহাস, উনি অত্র কলেজে ১০.০৩.২০১১ তারিখে যোগদান করেন। কিন্তু দিল আফরোজ শারমিন পারিবারিক সমস্যার কারণ দেখিয়ে  ১২.১০.২০২০ স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন। উনার এনটিআরসিএ’এর সদন জাল কি না তা আমার জানা নেই। তিনি বলেন, আমার কলেজে কর্মরত সকল শিক্ষকের সনদ সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়। 

গাইবান্ধা জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার, গোপালচরণ দ্বিমূখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ধর্মের সহকারি শিক্ষক মমতাজ বেগম। এনটিআরসিএ’র সনদ জাল বলে প্রমাণিত হওয়ায় এখন তিনি স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন। 

এ বিষয়ে অত্র স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মো. মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাভিশনকে বলেন, সে এখানে ইসলাম শিক্ষায় সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। উনার বিলের জন্য ২২.০৩.২০২০ সালে আবেদন করি। কিন্তু এনটিআরসিএ’এর সনদ জাল হওয়ায় তার ফাইলটি বাতিল করা হয়। 

জয়পুরহাটের জামালগঞ্জ কলেজ প্রভাষক সালমা জাহান শিরিন ও মনিরা খাতুন এনটিআরসিএ’র সদন জাল হওয়ায় তারা পদত্যাগ করেন। 

এ বিষয়ে কলেজের হিসাব রক্ষক কৃষ্ণ কুমার পান্ডে বাংলাভিশনকে জানান, মিনিস্ট্রি অডিটে তার সনদ জাল হওয়ায় তারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে চলে গেছে। 

পঞ্চগড়েও কয়েকটি স্কুলে বিভিন্ন চিত্র দেখা গেছে, কোথাও জাল সনদধারী শিক্ষক চিহ্নিত হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দিয়ে অধিদপ্তরের প্রস্তাবকৃত টাকা ফেরত দিয়েছেন, আবার কেউ চাকরি করছেন বহাল তবিয়তে। 

এ বিষয়ে উত্তর দর্জি পাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, মো. তোয়ালেদ হোসেন বাংলাভিশনকে বলেন, অভিযুক্ত শিক্ষক ০৮.০৯.২০১৪ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছেন। সরকারি কোষাগার থেকে প্রাপ্ত তার সমুদয় অর্থ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

শালডাঙ্গা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, সুরঞ্জিত কুমার সেন বাংলাভিশনকে বলেন, হুমায়ন করিব, সহকারি শিক্ষক, শরীরচর্চা। তিনি ২০১১ সাল থেকে অদ্যাবধি অত্র বিদ্যালয়ে চাকরি করে আসছে। যদিও আমরা একটি তালিকা আমরা দেখেছি, তার নামও সেই তালিকায় অন্তর্ভূক্ত আছে। তালিকার বিষয়ে হুমায়নকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এই তালিকা সঠিক নয়। কাগজ পত্রের দিক থেকে আমি সঠিক আছি। এই মর্মে সে এখন পর্যন্ত চাকরি করে যাচ্ছে।

 লালমনিরহাটের কুলাঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী মৌলভী আলম মোস্তফা অন লাইনে সনদ না পাওয়ার দায় চাপিয়েছেন মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের ওপর। বাংলাভিশনকে তিনি বলেন, আমাদের সময় অনলাইন কোন পদ্ধতি ছিল না। পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়েছি। এখন যদি অনলাইনে না পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের করার কি আছে, সেটা ওনারা দেখবেন। 

জাল সনদে কর্মরত শিক্ষকদের সম্ভাব্য তালিকা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও  নিরিক্ষণ অধিদপ্তরের যুগ্ম পরিচালক বিপুল চন্দ্র সরকারের সাথে কথা হয় বাংলাভিশনের। বাংলাভিশনের অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাপ্ত তালিকা নিয়ে বিস্তর আলোচনা শেষে আরো ভয়ংকর তথ্য দেন তিনি। 

বিপুল চন্দ্র সরকার বলেন, ২০১২ থেকে ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত দেশব্যাপী যেসব প্রতিষ্ঠান পরিদর্শণ করা হয়েছে তার মধ্যে- ঢাকা বিভাগে ৩৭০, চট্রগ্রাম বিভাগে ৫০, রাজশাহী বিভাগে ৪০৯ এবং খুলনা বিভাগে ২৭৪, এই চার বিভাগে মোট ১১০৩ জন জাল সনদধারী শিক্ষক রয়েছে।

তিনি বলেন, পরীক্ষা ও নিরীক্ষণ অধিদপ্তর মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করনে কাজ করে। মান সম্মত শিক্ষা নিশ্চিতে মান সম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজন। মান সম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিশ্চিতে মান সম্মত শিক্ষক পূর্বশর্ত। 

এ কারনেই আমরা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিরিক্ষা করে থাকি। নিরিক্ষা কালে আমরা দেখেছি অনেক জাল সনদে চাকরি করছেন। আমরা সকল যাচাই-বাছাই শেষে ব্যবস্থ গ্রহনের জন্য একটি প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করি। 

১৪ জুন-২০২২ পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা সচিবকে পাঠানো এক চিঠি থেকে জানা য়ায়, অবৈধ নিয়োগ, প্রাপ্যতার অতিরিক্ত গ্রহণ এবং জাল সনদের কারনে 

২০১২-১৩ অর্থ বছরে ১৫, ৬২, ০১, ৫৮৭ কোটি , ১৩-১৪ অর্থ বছরে ২১, ৫২, ৫৮, ৯৮৩ কোটি , ১৪-১৫ অর্থ বছরে ২২, ৭৭, ১০, ৭৫৫ কোটি , ১৫-১৬ অর্থ বছরে ৩১, ৭৯, ৫২, ৮৮৭ কোটি , ১৬-১৭ অর্থ বছরে ১২ কোটিরও বেশি , ১৭-১৮ অর্থ বছরে ৩২ কোটিরও বেশি , ১৮-১৯ অর্থ বছরে ৩৫ কোটিরও বেশি , ১৯-২০ অর্থ বছরে ৩৯ কোটিরও বেশি , ২০-২১ অর্থ বছরে ৫০ কোটিরও বেশি , ২১-২২ (মে-২২) পর্যন্ত ৩৩ কোটিরও বেশি। গড় হিসেবে বিগত দশ বছরে এসব খাত থেকে মন্ত্রণালয়ের আদায়যোগ্য টাকার পরিমাণ প্রায় তিনশ’ কোটি টাকা। এটা একটা খন্ডচিত্র সারাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাচাই করা হলে অবৈধ শিক্ষকরের সংখ্যা কয়েক হাজার হবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। 

জাল সনদধারী শিক্ষকের তালিকায় দেখা যায়, নন-গভমেন্ট টিচার্স রেজিষ্ট্রেশন অ্যান্ড সার্টিফিকেশন অথরিটি (এনটিআরসিএ) এর জাল সনদ সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন অভিযুক্তরা। এছাড়াও কম্পিউটার এবং বিএড এর সার্টিফিকেটও নকলেরও প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব বিষয়ে এনটিআরসিএ’র সাথে যোগাযোগ করলে ক্যামেরার সামনে কথা বলতে রাজি হননি কোন কর্মকর্তা। 

প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন অনুবিভাগ লিখিত বক্তব্যে বলছে, “বিভিন্ন আবেদনের প্রেক্ষিতে এনটিআরসিএ’র পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন অনুবিভাগে সংরক্ষিত ফলাফলের হার্ড/সফট কপি যাচাই অন্তে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সনদ যাচাই প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। সনদ যাচাই কালে যদি কোন জাল সদন পাওয়া যায় তখন উক্ত জাল সনদধারীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করে এ অফিসকে অবহিত করার জন্য সনদ প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠান প্রধানকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। তদানুযায়ী, এনটিআরসিএ অদ্যাবধি প্রায় ২৭০০ টি জাল শিক্ষক নিবন্ধন সনদ সনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমুহকে নিবন্ধনধারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানায় মামলা করার নির্দেশনা প্রদান করেছে। সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠান সমুহ উক্ত জাল সনদধারীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের/আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করে এনটিআরসিকে অবহিত করেছে”। 

অবৈধভাবে সনদ জালিয়াতি করে কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করলে যদি তা প্রমাণিত হয় তাহলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থার বিধান রয়েছে প্রচলিত আইনে। আইনজীবিরা বলছেন, ক্রিমিনাল ল এবং দেওয়ানি কার্যবিধির বিভিন্ন ধারায় তাদের শাস্তির বিধান রয়েছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও এসব অপকর্মের দায় এড়াতে পারে না। 

বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বাংলাভিশনকে বলেন, শিক্ষা আইন না থাকায় বিভিন্নভাবে দূষ্কৃতিকারীরা ছাড় পেয়ে যায়। ১৮৬০ সালে দন্ডবিধির ৬৮ ধারায় বলা হয়েছে, জাল জালিয়াতির মাধ্যমে কোন ডকুমেন্ট তৈরি করা হলে সাত বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। জাল সার্টিফিকেন আসল হিসেবে ব্যবহার করলে সেক্ষেত্রেও একই শাস্তির আওতায় আসবেন। ৪৭১ ধারা মতে, জালিয়াতির কারনে আলাদা ভবে একটা সাজার বিধান রয়েছে। 

৮৬৭ ধারায় আরো কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কোন ভ্যালুয়েবল সিকিউরিটি হিসাবে যদি এই কাজগপত্রগুলো ব্যবহার করা হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা দশ বছরের  শাস্তির বিধান রয়েছে। 

এই সমস্যার গোড়ায় গলদের কথা জানান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক প্রফেসর মো. শামসুল হুদা। বলেন, গভর্নিং বডি, ম্যানেজিং কমিটিসহ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টরা কোন ভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না। 

মাউশির সাবেক এই পরিচালক (কলেজ ও অ্যাডমিন) বলেন, এই বিষবাষ্পটা কিন্তু অনেক আগেই শুরু হয়েছে, যা ভিতরে ভিতরে তুষের আগুনের মতো জ্বলছিল। তিনি বিশেষ করে বলেন, এনটিআরসিএ হওয়ার আগে ম্যানেজিং কমিটি এবং গভর্নিংবডি এতটাই ক্ষমতা প্রাপ্ত ছিল, তারা সঠিক ভাবে যাচাই-বাছাই না করেই নিয়োগ দিত। 

এই কমিটি বিভিন্নভাবে প্রভাবিত হত বলেও জানান তিনি। শুধু জাল সার্টিফিকেট না বিধি অনুযায়ী নিয়োগ না হলেও তিনি চাকরি থেকে বহিষ্কৃত হতে পারেন। 

তিনি বলেন, তবে এখন প্রযুক্তি যথেষ্ট উন্নত। আমরা চাইলেই নিয়োগ পর্যায়েই বিষয়টি মিটিয়ে ফেলতে পারি। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরও অনেক আধুনিক হয়েছে। এখন ফলাফল সকল বোর্ডের ওয়েব সাইটটে আর্কাইভ করা আছে। সব বোর্ডের সাথে ডিআইএ’র আন্তঃলিঙ্ক থাকলে সহজেই এসব ফলাফল যাচাই করা সম্ভব। 

বিভি/এসআই

মন্তব্য করুন: