হাশিম ভাইের সাদা সাদা জীবন!

বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায় লাসালে আমার দিদির বাসায় আড্ডার মাঝে ভাগ্নি তোরসা হঠাৎ একটি গান ছেড়ে বললো, ‘শুনেন।’ টিভি স্ক্রিনে মুক্তির প্রতীক্ষায় থাকা মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ' হাওয়া' সিনেমায় এরফান মৃধা শিবলুর কন্ঠে সাদা সাদা কালা কালা গানটি শুনে চমকে উঠেছি। খুব পরিচিত কথা। কোথায় যেন শুনেছি আগে, স্মৃতি হাতড়ে বের করার আগেই আড্ডায় কে যেন বললো, ‘এই গানটি যার সে গাইতে পারেনি অসুস্থতার জন্য।’
কে সেই শিল্পী?
সুমনদা' ছোট করে উত্তর দেন,হাশিম মাহমুদ।
কি? হাশিম মাহমুদ!
আমার চমক তখন ভাঙে। বিস্মিত নয়নে টিভি স্ক্রিনে খুঁজে বেড়াই হাশিম মাহমুদের নাম। হাশিম ভাই, আমার শৈশব, কৈশোরের দুরন্তপনা দিনগুলোর প্রিয়মুখ। লেখালেখির সঙ্গী। একদা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে সাহিত্যবাসরের নিয়মিত ছড়াপাঠে একসঙ্গে অংশগ্রহণ ছিল অনিবার্য।
আশির দশকে হাশিম ভাইরা থাকতেন নারায়ণগঞ্জের মিশনপাড়ায়। প্রতি রবিবার এবং পরবর্তীতে শুক্রবার সকালে তাদের বাসায় আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। হাশিম ভাইদের বাসায় চা খেয়ে আমরা দু'জন বাসে চেপে চলে যেতাম পঞ্চবটি। ছড়াকার খালেদ হোসাইন ভাইদের সরদার পাড়ার বাসায়। কখনও আমাদের সঙ্গী হতেন মোবারক হোসাইন রিমন ভাই, মোস্তাফিজুর রহমান সুইট ভাই, কাজী শাহীদুল ইসলাম ভাই, বন্ধু রাকিবুল হাসান এবং নুরুল আলম মামা। খালেদ ভাই তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র। সাপ্তাহিক ছুটির দিন তিনি নারায়ণগঞ্জ চলে আসতেন। তখন আমরা ছুটে যেতাম খালেদ ভাইয়ের কাছে কড়কড়ে নতুন ছড়া নিয়ে। আমাদের ছড়াপাঠের পর খালেদ ভাই শুধু প্রশংসাই করতেন না, ছড়ায় ভুল ত্রুটিগুলো শুধরে দিতেন। নিয়মিত লেখার ও প্রচুর পড়াশুনোর জন্য উৎসাহ দিতেন। চা, মুড়ি, বিস্কুট খেতে খেতে আমরা শুনতাম হাশিম ভাইয়ের কন্ঠে রবীন্দ্রসংগীত। কখনও দেশাত্ববোধক গান। হাশিম ভাই তার অদ্ভুত মায়াবী কন্ঠে চারপাশ মোহাবিষ্ট করে রাখতেন।
আহা কি দিন গেছে আমাদের!
এ সময়ে হাশিম মাহমুদকে নিয়ে বেশ হৈ চৈ হচ্ছে। এই মানুষটির সহজ-সরলতার সুযোগ নিয়ে অনেকেই তাকে চরম ঠকিয়েছে। তার তারুণ্যে, যৌবনের ভরা সময় সবাই তাকে দিয়ে যত্রতত্র আড্ডায় গান গাইয়ে কিংবা রেকর্ডিং করে বিনিময়ে কিছুই দেয়নি। এমনও দিন কেটেছে চারুকলা হতে গভীর রাতে বাড়ি ফেরার ভাড়াটুকু পকেটে ছিল না। তিনি হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত শরীরে গুলিস্তান এসে পরিচিত কারো সঙ্গে নারায়ণগঞ্জ ফিরেছেন। সেই সব ইতিহাস বঞ্চনার, ঠকানোর। কিন্তু হাশিম ভাই কারো কাছে কখনও হাত পাতেননি। মাথা নত করেননি।
হাশিম মাহমুদ বোহেমিয়ান এক শিল্পী। গানের মানুষ, লেখার মানুষ। বাল্যকাল থেকে ছড়া, কিশোর কবিতায় তার হাতেখড়ি। ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, শিশু ও নবারুনে তার প্রচুর লেখা ছাপা হয়েছে । পাশাপাশি তিনি নারায়ণগঞ্জে স্টেজে অনেক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। সহজাত এই শিল্পীর ভরাট কন্ঠ তখন থেকেই আমাদের মুগ্ধ করেছে। নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক সংগঠন শাপলার সঙ্গে দীর্ঘকাল জড়িত ছিলেন। নিয়মিত যাতায়াত ছিল স্থানীয় সঙ্গীত বিদ্যালয় জয়জয়ন্তী জলসায়।
হাশিম ভাই শুধু গান করেন না, তিনি গীতিকারও। নিজের গান নিজেই লিখেন, সুর করেন এবং গেয়ে থাকেন। গানপাগল মানুষটি প্রচণ্ড আড্ডাবাজও। জীবনে কখনও চাকরির পিছনে ছোটেননি। শিল্প সাধনায় মগ্ন থাকতে চেয়েছেন। মানুষকে ভালবেসে বিনোদিত করতে চেয়েছেন। এসব করতে করতে বেলা কখন গড়িয়ে গেছে, সেই হিসেব মেলানোর সময় তার হয়ে উঠেনি। সংসার পাতা হয়নি। রয়ে গেছেন অকৃতদার।
নব্বই দশকের শুরুতে হাশিম মাহমুদ ঢাকামুখী হয়ে ওঠেন। নারায়ণগঞ্জের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সঙ্গে, বন্ধুদের সঙ্গে ত্রমশ দূরত্ব তৈরির মধ্য দিয়ে নিজেকে একটা সময় পুরোপুরি বিছিন্ন করে ফেলেন।
ঢাকায় হাশিম মাহমুদের প্রিয় প্রাঙ্গন হয়ে উঠে চারুকলা, মোল্লার দোকান, ছবির হাট, পাবলিক লাইব্রেরি ও শাহবাগ। শুনলে অবাক হবেন, শিক্ষার্থী না হয়েও শিক্ষার্থীদের মতো হাশিম মাহমুদ প্রতিদিন সকালে চলে আসতেন চারুকলায়, সারাদিন থেকে রাতে ফিরতেন। সেই সময় হাশিম ভাই আরও কয়েকজন মিলে একটি ব্যান্ডও করার চেষ্টা করেছিলেন। তার নাম দিয়েছিলেন ‘বৈরাগী’।
শুধু গানের মুগ্ধতাই না, হাশিম ভাইয়ের কথার মুগ্ধতায় পড়েছিলেন চারুকলার অনেকেই। এত মুগ্ধতা যাকে নিয়ে তার বাসা যে নারায়ণগঞ্জ-এ কথাটাই জানতেন না কেউ।
দেখতে দেখতে অনেক বছর চলে গেছে। হাশিম মাহমুদের আশেপাশের সঙ্গীদের অনেকে এখন স্বনামখ্যাত হয়েছেন। যশ, প্রতিষ্ঠা সবার হলেও হাশিম মাহমুদ কখনও এসব নিয়ে ইঁদুর দৌড়ে শামিল হননি। গান করেছেন মনের আনন্দে। বিনোদিত করেছেন শ্রোতাদের। সেই হাশিম মাহমুদ ভাই নিজের জন্য কখনও কারো কাছে কিছু না চাওয়া মানুষটি বয়সের আগেই যেন বৃদ্ধ হয়ে গেছেন! কিছুটা অসুস্থতার ভারে দুর্বল হয়েছে কন্ঠ। যার কারণে হাওয়া সিনেমায় কণ্ঠ দিতে পারেননি।
অসুস্থতার জন্য তিনি চারুকলায় অনিয়মিত হয়েছেন। নিরবে-নিভৃতে কেটে যায় তার সময়। পরিবারে তার ভাই, বোনসহ আরও কিছু আত্মীয়স্বজন রয়েছেন, তারাই এখন হাশিম ভাইয়ের দেখাশোনা করেন।
হাওয়া সিনেমার গান শুনে বারবার ফিরে যাচ্ছিলাম সেই কৈশোরে। কতদিন দেখি না প্রিয় মানুষটিকে! কেমন আছেন হাশিম ভাই?
বাসায় ফিরে নেট ঘেটেও তার কোনো ছবি পাইনি। ইউটিউবে হঠাৎ একটি নিউজে পেয়ে যাই তার বর্তমানের একটি ছবি। দেখে সাংঘাতিক কষ্টই পেলাম। অসুস্থতায় শরীর ভেঙে কি হাল হয়েছে! একটা সময় জীবনের শুরুতে প্রভাব রাখা মানুষটিকে এভাবে দেখে কষ্টই পেয়েছি।
হাশিম ভাইয়ের চারুকলায় কাটানো দিনগুলো সম্পর্কে খুব একটা জানি না। হাওয়া সিনেমার পরিচালক মেজবাউর রহমান সুমন খুব কাছ থেকে সেই সময় হাশিম ভাইকে দেখেছেন। তিনি এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, ‘চারুকলার সামনে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিল, সেটার নিচে বসতেন হাশিম ভাই। তখন মাঝে মাঝেই দেখা হতো। অনেক সময় দূর থেকে দেখতাম, তিনি কোনো ছেঁড়া কাগজে গান লিখছেন।’
সুমন আরও বলেন, ‘তার তো ইনকাম বলতে তেমন কিছু ছিল না। তাকে খেতেও দেখতাম না। মাঝে মাঝে আমরা যারা তার কাছের বা হাশিম ভাই যাদের পছন্দ করতেন, তারা টাকা দিলে নিতেন। কিন্তু এমনিতে যদি কেউ টাকা দিতে চাইতো, তিনি খুব রিঅ্যাক্ট করতেন।’
সুমন অনেক আগে স্টুডিওতে হাশিমের কিছু গান রেকর্ড করিয়েছিলেন। হার্ডডিস্ক নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেই গানও হারিয়ে যায় বলে জানান সুমন। তিনি এও জানান যে, নাটকে হাশিম ভাইয়ের একটি গান ব্যবহার করেছিলেন।
তিনি বলেন, ‘যখন আমরা হাওয়া সিনেমায় সাদা সাদা কালা কালা গানটা ব্যবহার করার জন্য হাশিম ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে দেখা করলাম, কিছু টাকা দিলাম, তারা বিস্মিত হলেন। তারা ভাবতেই পারেননি এমন কিছু একটা হতে পারে।’
গানটা হাশিম ভাই গাইতে না পারায় গেয়েছেন এরফান মৃধা শিবলু। ‘সাদা সাদা কালা কালা’ গানটি প্রকাশের পর হাওয়া সিনেমার মাধ্যমে হাশিম ভাইয়ের গানটি এখন অনেকেই শুনছে এবং তার নামটাও ছড়িয়ে যাচ্ছে। অবেলায় হাশিম ভাইয়ের এই নামডাক দেখে ভালোলাগায় শুধু মন ভরে ওঠেনি, একটু কষ্টও অনুভূত হলো। সময় যখন অনুকূলে ছিল তখন কেউ তাকে ভালো একটা অনুষ্ঠান দেয়নি। ক্যাসেট রেকর্ডিংয়ে এগিয়ে আসেনি। সময়ের বিবর্তনে তার লেখা, সুর করা অসংখ্য গান হারিয়ে গেছে। তবুও ভালো লাগলো হাশিম ভাইয়ের আরেকটি গান আলোচনায় এসেছে। গানটির শিরোনাম ‘তোমায় আমি পাইতে পারি বাজি’।
আমাদের শৈশব-কৈশোরের গর্ব হাশিম ভাই। আপনার সুস্থ ও মঙ্গলময় জীবন কামনা করি।
লেখক: কানাডা প্রবাসী।
বিভি/এনএ
মন্তব্য করুন: