মায়ের শূন্য ঘরটা আমাকে সবসময় তাড়িত করে

যখন ঢাকায় ছিলাম তখন প্রতি ঈদ, কোরবানি বা ছুটি ছাটা পেলে বাড়িতে যেতাম মাকে দেখতে। ২০০৩ সালের জুন মাসে কানাডা আসার আগে বাড়িতে গেলাম। একদিন সন্ধ্যার পর দেখি, মা তার ঘরে শুয়ে আছেন। কিছুক্ষন আগেই মাগরিবের নামাজ পড়া শেষ করেছেন। নামাজ পড়া শেষ হলেও মা অনেকক্ষন জায়নামাজে বসে থাকেন। আমি ঘুর ঘুর করছি মায়ের ঘরে যাওয়ার জন্য। যখন দেখলাম মা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছেন আমি আলগোছে মায়ের পাশে গিয়ে বসলাম। জুতা খুলে মায়ের পাশে আধশোয়া হয়ে পা মেলে দিলাম।
মায়ের হাতটা হাতে নিলাম। মাথার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছিলাম। উড়োখুড়ো চুল, জটা লেগে আছে। মনে হয় কয়েকদিন তেল পড়েনি চুলে, চিরুনি বুলানো হয়নি। পরিস্কার ধবধবে সাদা শাড়ি, কালো পাড়। শাড়িটা আমারই কিনে দেওয়া। নীল স্ট্রাইপের বিছানার চাদর, ম্যাচিং বালিশের কভার। বিছানার চাদরটাও আমি কিনে এনেছিলাম ঢাকা থেকে। জানালার পর্দা একটু ফাঁক করা। লাল রঙের লোহার গ্রিল। সেখানে একটা পেয়ারার ডাল এসে পড়েছে। দেয়ালে পালতোলা নৌকার ক্যালেন্ডার। উপরের তাকে একটা সুটকেসে মায়ের সরঞ্জাম। পাশের টেবিলে ওষুধ, পানির জগ আর পানের ডিব্বা। মাথার উপর ফ্যান ঘুৱছে, একটা স্বল্প পাওয়ারের লাইটের আলোতে মাকে খুউব রোগা লাগছে।
২
মা বললেন, কিছু বলবা!
মা জানে যখনই আমি তার খুব কাছ ঘেসে বসি তখনই কিছু একটা দাবী দাওয়া থাকে আমার। ছোট বেলা থেকেই এই অভ্যাস। মায়ের বুকের মধ্যে লেপ্টে থাকতাম। মাকে পাটানোর কৌশল। মা আমার চালাকি সব বোঝেন।
-আপনার শরীর তো ভেঙ্গে গেছে মা। শুকিয়ে গেছেন। আপনি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেন না!
-খাইতো।
-না খেলে শরীর আরো ভেঙ্গে পড়বে। পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। আমি যে এতো কিছু কিনে দিয়ে যাই সেগুলো তো সব মানুষকে দিয়ে দেন।
-তোমারে কে বলছে খাই না। খাই।
-আমি তো দেখি আপনি বাটিতে একটু ভাত নিয়ে ঘরময় ঘোরেন আর খান। টেবিলে বসে শান্তিমতো খেতে দেখি না কখনও। ঠিকমতো ওষুধও খান না। ফল আনি তাও মানুষকে দেন।
-তুমিওতো শুকাইয়া গেছো।
-আমি ঠিক আছি। আপনার কিছু লাগলে বলবেন।
-কিছু লাগবে না বাবা। শুধু ভাংতি টাকা দিয়া যাইও। গরীবকে দিতে হয়। তুমি আসলে সবাই আসে।
একসময় আমি আসল কথাটা বললাম, মা আমি কানাডা চলে যাচ্ছি।
মা প্রথমে বুঝতে পারেন নি। বললেন, কানাডা কি অনেক দুর! কতদিন থাকবা!
মা জানে আমি প্রায়ই বিদেশে যাই। কানাডাও সেরকম মনে করেছে।
-হ্যাঁ মা। অনেকদুর। আমেরিকার মতো দুর।
এর আগে আমি দুবার আমেরিকা গেছি মা জানেন।
-সাবধানে থাইকো।
-এবার সবাই যাচ্ছি মা। একবারে।
মাকে আগে ভাগে বলিনি যে আমি কানাডা চলে যাব। মা খুবই অবাক হলেন। বাক্যহারা হয়ে গেলেন!অনেকক্ষন কিছু বলতে পাৱলেন না।
-আর আসবা না!
-আসব না কেনো, আসব। চিন্তা করবেন না।
৩
ঢাকা থেকে যেমন বছর বছর যেতাম বরিশাল তেমনি কানাডা আসার পরও প্রতি বছর দেশে গিয়েছি, বরিশাল গিয়েছি। মাকে বুঝতে দিতে চাইতাম না যে আমি অনেক দুরের এক দেশে থাকি যেখান থেকে চাইলেই ছুটে আসা যায় না। মা একদিন বললেন, তুমি একটা পাখি, এই দেখি আবার দেখি নাই। তারপর মা কাঁদেন।
২০১০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর মা মারা যান। মা মারা যাওয়ার পরও প্রতিবছর দেশে গিয়েছি। মায়ের কবরের কাছে গিয়ে বসে থাকি। মায়ের সাথে গোপন কষ্টের কথা হয়। মানুষেৱ অবহেলা, অপমানের কথা বলি, লেখার কথা বলি, সন্তানের কথা বলি। তারপর মন শান্ত হয় আমাৱ। মা আমাকে ঠিক দেখতে পান। মানুষতো আর শুধু দেহেই বাঁচে না। মানুষ বেঁচে থাকে স্মরনে, মননে।
২০১০ সালের পর থেকে প্রতিবছর বরিশাল যাই ঠিকই কিন্তু কখনও বাড়িতে রাত কাটাইনি। কারন রাত বাড়তে থাকলেই মায়ের শূন্য ঘরটা আমাকে অনেক কষ্ট দেয়, আমি মেনে নিতে পারি না যে মা নাই। মায়ের ঘরটায় একটা পুরনো বেতের সোফা আজও আছে। সেখানে একটু বসে থাকি। তারপর হোটেলের নিঃসঙ্গ কক্ষে ফিৱে আসি। মা নাই যে বাড়িতে সেই বাড়িতে আমি কিভাবে থাকব!
টরন্টো ৮ নভেম্বর ২০২২
জসিম মল্লিক, কানাডা প্রবাসী লেখক-সাংবাধিক
মন্তব্য করুন: