পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা প্রসবোত্তর হতাশা কেন হয়? সমাধান কী?

মাতৃত্ব নারীর জীবনের সবচেয়ে বড় অধ্যায়। বলা হয়, মাতৃত্বেই পূর্ণতা। আর তাই তো সন্তানের আগমনী বার্তা থেকে শুরু করে প্রসব যন্ত্রণার পুরোসময়টা কিন্তু একজন মা মায়াভরা স্বপ্ন নিয়েই উপভোগ করেন। সন্তান প্রসবের পরবর্তী সময়ে নব্য মায়ের চোখজুড়ে ফুটে উঠে সেই পূর্ণতা।
তবে কখনো কখনো দৃশ্য বদলায়। সম্প্রতি নেট দুনিয়ায় ভাইরাল হয়েছে রংপুরের তারাগঞ্জে ৬ মাস বয়সী কন্যা জুহি রানীর মৃত্যুর ঘটনা। ছোট্ট জুহীকে গলা কেটে হত্যা করেছে মা তুলসি রানী (২৭)। এক ভিডিওতে দেখা যায় নিজের সন্তানকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা অবলীলায় স্বীকার করছেন মা। সন্তান প্রসবের পর সাত রাজার ধন কাছে পেয়েও সুখসাগরে ভাসতে পারেনি তুলসি রানী। মাতৃত্বের স্বাদ তার কাছে বিষাদময়তায় পরিণত হয়েছিল। এমন বিষাদের ছায়া নেমে আসে অনেক সদ্য মায়ের জীবনেই। কিন্তু কেন এমন ভঙ্গুর মানসিক পরিস্থিতি হয়? এর প্রতিকার-ই বা কী?
প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়েদের এক ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়, যা সাধারণ বিষণ্ণতার বা হতাশার পর্যায়ে থাকে না। তখন শারীরিক (রাসায়নিক), আবেগীয় এবং আচরণগত অনেক পরিবর্তন ঘটে। DSM-5 অনুযায়ী এটি একটি মানসিক সমস্যা, যা কি না সন্তান প্রসবের চার সপ্তাহের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। যদিও এটির কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। বরং বিষণ্ণতার তীব্রতার ওপর নির্ভর করে এর সময়সীমা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, প্রায় ১০ শতাংশ নারী গর্ভাবস্থায় এবং ১৩ শতাংশ নারী সন্তান জন্মের পর বিষণ্ণতায় ভোগেন।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন বা প্রসবোত্তর বিষণ্ণতা কী?
শুনতে অবাক লাগলেও পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মায়ের ক্ষেত্রেই অন্তত এক-দুইবার এমন পরিস্থিতি হয়েছে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে একজন নারীকে ৮-৯ মাস বা তারও বেশি সময় ধরে যে শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হয়, তার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তখন প্রসবের দু’-তিনদিন পর থেকেই অনেক মায়ের মুডসুইং হয়। এর ফলে তার মেজাজ পরিবর্তন, কান্না কান্না ভাব, উদ্বেগ, রাতে ভালো ঘুম না হওয়া প্রভৃতি সমস্যা হতে শুরু করে। এসবের মাত্রা তীব্র হতে পারে ক্ষেত্র বিশেষে। সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী হলে এবং সমস্যার মাত্রাও স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি হলে নব্য মায়ের বিষণ্ণতা চরম মাত্রায় পৌঁছায়, তখন এ পর্যায়টিকে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশন হিসেবে ধরা হয়।
এমনই সমস্যায় ভুগেছেন শ্রাবণী যোয়ানা গমেজ। তিনি বলেন, সন্তান প্রসবের পরবর্তী পিরিয়ডে তার অধিক মাত্রায় অস্থির লাগত। অন্ধকারে থাকতে ভয় লাগতো, বন্ধ জায়গায় থাকতে পারত না। সবচেয়ে বড় সমস্যা বাচ্চাকে কোলে নিতে ইচ্ছা করতো না, বাচ্চাকে নিয়ে ঘুমাতে গেলে ভয় লাগতো, বাচ্চাকে কাছে আনলে রাগ হতো। মাঝে মাঝে রাগে মেরে ফেলার মতো ভাবনা আসতো।
এ রোগের লক্ষণ, কারণ, কারা এ রোগের ঝুঁকিতে থাকেন এবং এর সমাধান নিয়ে বাংলাভিশনের সঙ্গে কথা বলেছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রুবাইয়াৎ ফেরদৌস। বিশেষজ্ঞের সকল পরামর্শ তুলে ধরা হলো:
উপসর্গ বা লক্ষণ:
# বেশিরভাগ সময়ই বিষণ্ণ থাকা, সহজেই বিরক্ত হওয়া, অতিসংবেদনশীলতা।
# সবকিছু অতিরিক্ত মনে হওয়া, হতাশ লাগা, নিরাশ লাগা।
# দুঃখ, অসহায় বা অপরাধবোধের মতো নেতিবাচক অনুভূতি। নিজেকে খারাপ মা মনে করা।
# অবসাদগ্রস্ততা ও দুর্বল লাগা।
# ঘনঘন আবেগের পরিবর্তন।
# কান্না বা কান্নার ভাব হওয়া/কোনো কারণ ছাড়াই কান্না আসা।
# মনসংযোগের অভাব।
# সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা।
# পছন্দের কাজগুলো অপছন্দ হতে থাকা।
# দুশ্চিন্তা করা।
# রেগে যাওয়া।
# স্মৃতিশক্তির সমস্যা।
# ঘুমের সমস্যা/বারবার ঘুম ভেঙে যাওয়া/ একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম না আসা।
# খাবারে অনিহা /অতিরিক্ত খাওয়া।
# মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, পেশিতে ব্যথা, পিঠ ব্যথা ইত্যাদি।
# যৌন আকাঙ্ক্ষা কমে যাওয়া।
# কাউকে আঘাত করতে ইচ্ছা করা, এমনকি নিজেকে বা নবজাতক শিশুকেও আঘাত করতে ইচ্ছা করা।
# বাচ্চাকে বিরক্ত লাগে, নিজের সন্তান বলে মনে হয় না, বন্ধন তৈরি করতে না পারা।
# নিজেকে অপদার্থ, অকেজো বলে মনে হওয়া।
# পরিবার ও বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বা পালাতে চাওয়া।
# মৃত্যুর চিন্তা এমনকি আত্মহত্যার চিন্তা আসা।
পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের কারণ কী?
# গর্ভধারণের পূর্বে বা গর্ভাবস্থায় বিশেষ করে শেষের তিন মাস যদি ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশন থাকে বা অন্যান্য মানসিক রোগের ইতিহাস থাকে।
# অনাকাঙ্ক্ষিত বা অপ্রত্যাশিত গর্ভধারণ।
# অতি অল্প বয়সে গর্ভধারণ।
# সংখ্যাধিক্য সন্তান থাকলে।
# সময়ের আগে শিশুর জন্ম অথবা স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে জন্ম হওয়া।
# বিষণ্ণতার পারিবারিক ইতিহাস থাকলে।
# সাম্প্রতিক অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে যেমন: প্রিয়জনের মৃত্যু ,চাকরি হারানো, সাম্প্রতিক বিবাহ বিচ্ছেদ, মা-বাবা বা সন্তানের গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা ইত্যাদি।
# যমজ, ট্রিপলেট বা অন্যান্য জটিলতা থাকলে।
# স্বামী ও পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতার অভাব।
# বৈবাহিক কলহ।
# মায়ের সাথে পরিবারের অন্যদের ভালো সম্পর্ক না থাকা।
# একা বসবাস করলে।
# মা মাদকাসক্ত হলে।
# হরমোনের তারতম্য- গর্ভকালীন সময়ে এসট্রোজেন এবং প্রোজেস্টেরনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ গুণ বেড়ে যায়। আর প্রসবের পর অতি দ্রুত অনেক কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় এই তারতম্য একটি অন্যতম কারণ বলে ধারণা করা হয়।
# অপর্যাপ্ত ঘুম ও খাদ্যগ্রহণ।
# অন্তর্নিহিত অসুখ।
# উদ্বিগ্নতা।
# নিজের শারীরিক অবয়বের পরিবর্তন মেনে নিতে না পারা।
# হাইপোথাইরয়েডিজম থাকলে।
# আর্থিক অনটন।
# শৈশবকালীন কোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার ইতিহাস থাকলে।
# শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের পূর্ব ইতিহাস থাকলে।
# স্ট্রেসপূর্ণ জীবনযাত্রা।
প্রতিরোধের উপায় কী? মোকাবিলা কীভাবে করবেন?
# নিজের প্রতি যত্নবান হতে হবে।
# মনের কথা কাছের মানুষকে খুলে বলুন ও সহযোগিতা চান, একা থাকবেন না।
# পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, ঘুমান ও সেরোটোনিন সমৃদ্ধ খাবার খান।
# নিজের কাছে অতিরিক্ত আশা করবেন না। কারণ আপনার পারগতার মধ্যে সীমাবদ্ধতা আছে, মেনে নিন। যতটুকু পারবেন, ততটুকুই করবেন।
# মাঝে মাঝে বাইরে ঘুরতে যান। সাজগোজ করে, নিজেকে নিজের সামনে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করুন।
# "ধীরে চলো নীতি "-তে এগোন। এখনই সব পেরে উঠবেন না, ধীরে ধীরে সবই পারবেন।
# এক্ষেত্রে স্বামীর ভূমিকা অন্যতম। স্বামীকে একটি সুস্থ, স্বস্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে ও বাচ্চার লালনপালনে সহযোগিতা করতে হবে।
# বিলম্ব না করে চিকিৎসা নিতে হবে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
# যদি দুই সপ্তাহের বেশি উপসর্গগুলো থাকে।
# স্বাভাবিক কাজকর্মগুলো করতে যদি অপারগ হয়ে পড়েন।
# দৈনন্দিন কাজ বা ঘটনার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারেন।
# অতিমাত্রায় উদ্বেগ বা আতঙ্কগ্রস্ত থাকলে।
# সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো-নিজের বা বাচ্চার ক্ষতি করতে ইচ্ছা করলে বা সহিংস হয়ে উঠলে অতিসত্ত্বর যোগাযোগ করবেন।
মা ও শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মমতাজ উদ্দিন বলেন, যেহেতু সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে একজন নারীকে প্রচুর শারীরিক ও মানসিক কষ্ট সহ্য করতে হয়। ফলে সন্তান জন্মদানের ওই সময় ও কিছু পরে তার মন স্বাভাবিকের চেয়েও কোমল ও স্পর্শকাতর থাকে। আর ঠিক সেই সময়টাতেই তার ওপর বিষণ্ণতা ভর করে। এতে অনেকে খুব ঘাবড়েও যান। তখন তিনি নিজের ওপর অহেতুক সন্দেহ করতে থাকে এবং তার আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে।
সেক্ষেত্রে জেনে থাকা ভালো যে, মাতৃত্বকালীন বিষণ্ণতা মোটেই কোনো চারিত্রিক ত্রুটি বা দুর্বলতা নয়। দীর্ঘ ন’মাস ধরে এত কষ্ট, এত শারীরিক যন্ত্রণা ভোগ করার পর, কিছুদিন যদি কেউ মানসিকভাবে দুর্বল বোধ করেন, তাতে দোষের কিছুই নেই।
তবে পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে সেটির চিকিৎসা নিয়ে নিলেই দ্রুততম সময়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব। এমনকী সন্তানের সাথে চমৎকার বন্ধন গড়ে তোলা সহজ।
বিভি/টিটি
মন্তব্য করুন: