দেশীয় প্রযুক্তিতে পারমাণবিক বিকিরণ নিরাপত্তায় মুবিনের দারুণ উদ্ভাবন
 
								
													দেশের সর্বত্র যখন রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সুরক্ষা নিয়ে চলছে নানা আলাপ আলোচনা ঠিক তখনি বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিকিরণ সনাক্তকরণ এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা উদ্ভাবন করে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী মুবিন হোসাইন অমিয় দেশের পারমাণবিক নিরাপত্তা খাতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছেন। তার উদ্ভাবিত প্রকল্প 'RADSAFE' সম্প্রতি বাংলাদেশ আইসিটি অ্যান্ড ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ডস ২০২৫-এ চ্যাম্পিয়ন গোল্ড অ্যাওয়ার্ড অর্জন করেছে। তারই সাথে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে তাইওয়ানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এশিয়া প্যাসিফিক আইসিটি এলায়েন্স এ্যাওয়ার্ড ২০২৫ এ নির্বাচিত হয়েছেন।
প্রযুক্তি নির্ভরতার শিকল ভাঙার স্বপ্ন 
বাংলাদেশের হাসপাতাল, গবেষণা কেন্দ্র এবং আগামীর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে বিকিরণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু বিদেশি প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীলতা এবং উচ্চমূল্য এই খাতের সবচেয়ে বড় বাধা। একটি রেডিয়েশন ডিটেক্টর কিনতে খরচ হয় ২ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা, যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অনেক চিকিৎসা কেন্দ্রের সাধ্যের বাইরে।  
"প্রযুক্তি কেনা মানেই সেটার মালিক হওয়া নয়, যতক্ষণ না আমরা নিজেরা সেটা তৈরি করতে পারি," মুবিনের এই মতাদর্শই RADSAFE তৈরির মূল প্রেরণা। তিনি দেশেই তৈরি করেছেন স্বল্পমূল্যের কিন্তু উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিকিরণ নিরীক্ষণ ব্যবস্থা।
দেশের চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর জরুরি সমস্যা:  
মুবিন জানান, দেশের অধিকাংশ মেডিসিন এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একই সমস্যা বিদ্যমান - ত্রুটিপূর্ণ রেডিয়েশন ডিটেক্টর। যন্ত্র নষ্ট হলে মেরামত করতে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগে। ফলে অনেক চিকিৎসা কেন্দ্রে ত্রুটিপূর্ণ ডিটেক্টরগুলো অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে। এটি শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং চিকিৎসক এবং রোগীদের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করে।  
RADSAFE এই নির্ভরশীলতার অবসান ঘটাতে ডিজাইন করা হয়েছে। এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের একটি সমাধান।
অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয়  
RADSAFE একটি সম্পূর্ণ বিকিরণ শনাক্তকরণ ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা যা ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং মেশিন লার্নিং এর সমন্বয়ে তৈরি। যন্ত্রটি তাপমাত্রা, আর্দ্রতা, বায়ুচাপ এবং বাতাসের মান সম্পর্কিত তথ্য রিয়েল-টাইমে সংগ্রহ করে এবং একটি ওয়েব-ভিত্তিক মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে প্রদর্শন করে।  
মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম অস্বাভাবিকতা বিশ্লেষণ করে জরুরি সতর্কতা চালু করতে পারে। বিকিরণ ছড়িয়ে পড়ার মুহূর্তে এর রিয়েল-টাইম ডেটা বিশ্লেষণ করে বিকিরণ দুর্ঘটনা এলাকায় আটকে পড়া মানুষদের নিরাপদে বাহিরে নিয়ে আসার পথ নির্ধারণ করতে সক্ষম। পারমাণবিক দুর্ঘটনা বা চিকিৎসা বিকিরণ ছড়িয়ে পরার ক্ষেত্রে এটি প্রাণ বাঁচাতে পারে, যেখানে প্রতিটি সেকেন্ড গুরুত্বপূর্ণ।
প্রযুক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে, RADSAFE গাইগার-মুলার টিউব এবং মাল্টি-প্যারামিটার সেন্সর দিয়ে তৈরি, যা একটি মাইক্রোকন্ট্রোলারের সাথে সংযুক্ত এবং ক্লাউডে তথ্য প্রেরণ করে। সিস্টেমের ওয়েব ইন্টারফেস এআই-ভিত্তিক বিশ্লেষণ সংযুক্ত করে, যা আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) নিয়মকানুন অনুসরণ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
চ্যালেঞ্জ এবং সাফল্যের গল্প  
"এক বছরেরও বেশি সময় লেগেছে," মুবিন স্মরণ করেন। "সেন্সর ক্যালিব্রেট করা থেকে সফটওয়্যার ডিবাগিং পর্যন্ত অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ এবং ভুলের কারণে অনেক সময় এবং অর্থ হারিয়েছি। এটি হতাশাজনক ছিল।"  
তবে তার সুপারভাইজার প্রফেসর ড. আবদুস সাত্তার মোল্লা, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের পারমাণবিক নিরাপত্তা ও বিকিরণ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক, তাকে অনুপ্রাণিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। "তিনি আমার কাজকে যেভাবে মূল্য দিয়েছেন এবং অনুপ্রাণিত করেছেন, তা অসাধারণ ছিল," মুবিন কৃতজ্ঞতার সাথে বলেন।
তিনি বলেন যখন চ্যাম্পিয়ন গোল্ড অ্যাওয়ার্ড বিজয়ী হিসেবে তার নাম ঘোষণা করা হয়, এটি শুধু তার একার বিজয় ছিল না, বরং দেশীয় উদ্ভাবনের বিজয় ছিল।
সামাজিক প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা 
মুবিন বিশ্বাস করেন যে এই উদ্ভাবন দীর্ঘমেয়াদী সামাজিক প্রভাব ফেলবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে RADSAFE প্রবর্তনের মাধ্যমে তিনি বিকিরণ সম্পর্কে জনসাধারণের ভয় দূর করতে এবং এর ব্যবহার ও ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে চান।  
"চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মতো দুর্ঘটনার কারণে মানুষ প্রায়ই বিকিরণকে ভয় পায়," তিনি ব্যাখ্যা করেন। "কিন্তু নিরাপদ এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করলে বিকিরণ জীবন বাঁচাতে পারে।"
মুবিন ইতিমধ্যে কোম্পানি এবং গবেষণা সংস্থার সহযোগিতা খুঁজছেন যাতে তার বানানো উদ্ধাবন তিনি বাজারজাত করতে পারেন, তার লক্ষ্য এটিকে বিকিরণ পর্যবেক্ষণের জন্য জাতীয়ভাবে গৃহীত উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা - যা বাংলাদেশে তৈরি এবং বাংলাদেশের জন্য একটি ব্যবস্থা।
এই তরুণ উদ্ভাবকের গল্প প্রমাণ করে যে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, কঠোর পরিশ্রম এবং দেশপ্রেম দিয়ে প্রযুক্তিগত আত্মনির্ভরতা অর্জন সম্ভব। RADSAFE শুধু একটি যন্ত্র নয়, এটি বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত স্বাধীনতার দিকে একটি পদক্ষেপ।
বিভি/টিটি
 
						





 
							
							 
						 
 
										 
							 
							 
							 
							 
							 
							 
							 
							 
							 
							
 
											 
											 
											 
											
মন্তব্য করুন: