পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন; আইন কি বলে? (ভিডিও)
নারী ঘটিত দ্বন্দ্বের জেরে সম্প্রতি শাহবাগ থানা হেফাজতে পুলিশের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন ছাত্রলীগের দুই নেতা। ছাত্রলীগের এই নেতা হলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈম এবং ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক ও ঢাবির শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিম। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তারা গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, ‘রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার হারুন অর রশীদের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল তাদের ওপর এই অমানুষিক নির্যাতন চালায়’।
ঘটনার পরপরই ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয় দেশজুড়ে। ওঠে সামলোচনার ঝড়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ছাত্রলীগের ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া। এতে, জড়িত থাকার অভিযোগে হারুনকে রমনা জোন থেকে প্রত্যাহার করে দুই দফার বিভিন্ন স্থানে পদায়নের পর অবশেষে সাময়িক কর্মাব্যহতির মতো পদক্ষেপ নেয়া হয় পুলিশের পক্ষ থেকে।
এখন প্রশ্ন হলো থানায় নিয়ে হেফাজতে নির্যাতন কতটা আইনসিদ্ধ? বা এ ঘটনায় আইন কি বলে? সিনিয়র আইনজীবী ড.শাহদীন মালিক অবশ্য বিষয়টিকে ফোজদারী অপরাধ হিসেবে দেখছেন। তার মতে, জাতিসংঘের নির্যাতন বিরোধী সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৩ সালে 'নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন' করে। সে অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে নির্যাতনের কোনো সুযোগ নেই। সেক্ষেত্র এটাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে ভুক্তভোগীর আদালতে অভিযোগের বিধান রয়েছে। অথবা, ভুক্তভোগীর পক্ষে অন্য কেউ এমনকী পুলিশ বাদী হয়েও মামলা দায়েরের কথা বলে হয়েছে বলেও জানান বিজ্ঞ এই আইনজীবী। তবে, অভিযুক্ত এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা কেন হলোনা সে বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি। বলেন, ফৌজদারি আইনে মামলা না করে ‘হেফাজত ও (মৃত্যু) নিবারন আইন মানা হয়নি, এখানে ফৌজদারি অপরাধে মামলার বিধান অমান্য করাও একধরণের দায়িত্বে অবহেলা বলেই মনে করছেন তিনি। সেইসাথে পুলিশের এক নারী সহকর্মীকে কেন্দ্র করে বারডেম হাসপাতালে প্রশাসন এবং পুলিশ ক্যাডারের কর্মকতাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনাও সরকারী কর্মচারী বিধিমালার ব্যত্যয়। যা শাস্তিযোগ্য বলেই মনে করছেন বিজ্ঞ এই আইনজীবী।
আইনে কী আছে ?
নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের শুরুতে বলা হয়েছে, নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতা প্রদানের লক্ষ্যে এই আইন করা হয়েছে। ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী একটি সনদ স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর ওই সনদে বাংলাদেশও অংশীদার হয়েছে। নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, নির্যাতন বলতে কষ্ট হয়, এমন ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
শাস্তি কী ?
নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন বলছে, নির্যাতনের অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। আর নির্যাতনের ফলে যদি কেউ মারা যান, তাহলে অভিযুক্ত কর্মকর্তার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
তবে, এমন ঘটনা ঘটতে থাকলেও এই আইনের খুব বেশি চর্চা হয় না বলে মনে করছেন মানবাধিকার কর্মীরা। আর একারণেই এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি বলে মনে করেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নুর খান লিটন। বলেন, হেফাজতে নির্যাতন কোনভাবেই সমর্থন করে না মানবাধিকার। সেইসাথে এটির বাস্তবায়নে আইনটি সম্পর্কে যথেষ্ট প্রচারণার অভাব ও মানুষের অজ্ঞতাকেও দুষছেন তিনি।
এদিকে, এই ঘটনাকে সামাজিক অপরাধ হিসেবেই দেখতে চান সমাজ ও অপরাধ বিজ্ঞানী জিয়া রহমান। তার ব্যাখ্যাটা একটু ভিন্নরকম। তিনি এই ঘটনাকে সমাজের অবক্ষয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যাকেই দায়ী করছেন। সেইসাথে ছাত্রলীগের আহত নেতাদের ভূমিকায় প্রশ্ন তুলে বলেন, সেখানে (বাড়ডেমে)ছাত্রলীগ নেতারাতো আর ছাত্রলীগ হয়ে যায়নি, সেখানে তারা একটি নির্দিষ্ট এলাকার প্রতিনিধি হয়ে গিয়েছে। আর সেখানে প্রশাসন এবং পুলিশ ক্যাডারের শক্তি প্রদর্শণের লড়াই হয়েছে। তবে, পরবর্তীতে থানায় এনে তাদের এভাবে নির্যাতন কোনভাবেই আইনসিদ্ধ ও সমাজসিদ্ধ হয়নি। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার রক্ষার চেয়ে আরো বেশি ঢাক ঢোল পিটিয়ে নিজেদের অপরাধকে আরো সামনে আনা হয়েছে উল্লেখ করে এই অপরাধ বিজ্ঞানী বলেন, এডিসি হারুন, সানজিদা বা এপিএস আজিজুল হক তারা তাদের নিজেদের সমস্যা আইনের মাধ্যমে সমাধান না করে নিজেদের পেশি শক্তির জানান দিয়ে অপরাধ করেছে। তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে এসব সমস্যার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে বলেই আশংকা করেন তিনি।
তবে, পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনায় ২০১৩ সালের আইন অনুযায়ী ভুক্তভোগী বা অন্য কারো পক্ষ থেকে কোন ফৌজদারী মামলা হয়নি। আর নারী ঘটিত বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে মারামারি সরকারী কর্মচারীদের আচরন বিধি লংঘন। যেটিকেও ফৌজদারী অপরাধ বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
বিভি/রিসি
মন্তব্য করুন: